কয়েকজন যুবক দোকানের সামনে দাঁড়ানো, কেউ কেউ ঘোরাঘুরি করছে। এবং কারো হাতে লোহার রড ও পাইপ। হঠাৎই দোকানে ঢুকে এলোপাতাড়ি হামলা ও ভাঙচুর। এমনই দৃশ্য দেখা যায় হাতে আসা সিসি টিভির ফুটেজে।
আবার আরেকটিতে দেখা যায় এক পুলিশ সদস্য ভিডিও করা নিয়ে ব্যস্ত, আরেক পুলিশ সদস্য হামলাকারীর একজনকে মারের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করছে।
ঘটনাটি ঘটেছে নওগাঁর আত্রাই উপজেলার ঐতিহ্যহাসিক পর্যটন স্থান হিসেবে পরিচিত পতিসর বাজারে।
অভিযোগ উঠেছে রিফাত হোসেন (২৫) নামের এক ছাত্রদল নেতার নেতৃত্বে মুক্তি ফার্মেসী নামক ঔষধের দোকানে হামলা, ভাঙচুর ও ব্যবসাীকে মারধরের ঘটনা ঘটেছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ চাঁদার দাবিতে হামলা চালিয়ে পল্লী চিকিৎসকসহ দুই ভাইকে গুরুতর জখম করা হয়েছে।
গত সোমবার (২০ অক্টোবর) বিকেল উপজেলার পতিসর বাজারে মুক্তি ফার্মেসীর স্বত্বাধিকারী পল্লী চিকিৎসক ফিরোজ কবির ও তার ভাই একরামুল হকের ওপর এই হামলার ঘটনা ঘটে। এতে গুরুতর আহত হয় তারা। প্রকাশ্যে এমন হামলার ঘটনার পর থেকেই স্থানীয়দের মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এছাড়া পুলিশের উপস্থিতিতে এই মারধর হয়েছে বলে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন।
অভিযোগ ওঠা রিফাত হোসেন আত্রাই মোল্লা আজাদ মেমোরিয়াল সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রদলের সভাপতি ও ভরতেঁতুলিয়া গ্রামের মামুনুর রশিদের ছেলে।
এদিকে ভুক্তভোগীদের ভাই মাসুদুর রহমান ভরতেঁতুলিয়া গ্রামের রিফাত হোসেন, রিংকু, আশিক ও গণ্ডগোয়ালি গ্রামের সাজুর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ১০-১২ জনকে আসামি করে থানার মামলা করেছেন।
হামলার ওই সিসি টিভির ফুটেজ এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। হাতে আসা সিসি টিভির ফুটেজে দেখা যায়- ফিরোজ কবির দোকানে একটি চেয়ারে বসা। এসময় তার দোকানের সামনে কয়েকজন ক্রেতা থাকলে তাদেরকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর কিছুক্ষণের মধ্যে ছাত্রদল নেতার রিফাতসহ ৮-১০ জন পাইপ ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ভাঙচুর শুরু করে। এসময় ফিরোজ কবির ভিত্তরে চলে গেলে হামলাকারী কয়েকজন দোকানের ভিতর গিয়ে তাকে মারধর করে। তিনিও প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে ফিরোজ দৌঁড়ে বাইরে চলে আসলে হামলাকারীরা দোকান থেকে বের হয়ে ফিরোজের ছোট ভাই একরামুলকেও মারধর করে। পরে হামলাকারীরা চলে যেতে চাইলে একজনকে আটক করে নিয়ে আসতে দেখা যায় স্থানীয়দের। এসময় সিসিটিভির ফুটেজে আত্রাই থানার এএসআই মামুনুর রশিদ স্থানীয়দের কিছু একটা বলে দাঁড়িয়ে থাকেন। আরেক পুলিশ সদস্য মোবাইলে ভিডিও ধারন করছিলেন।
ভুক্তভোগী ফিরোজ কবির বলেন, কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি রিফাত বেশ কিছুদিন আগে আমার কাছে থেকে চাঁদা দাবি করে আসছিলেন এবং মোবাইলে হুমকি-ধামকি দিতেন। চাঁদার টাকা না দেওয়ায় ঘটনার আগের দিন ১৯ অক্টোবর রাতে রিফাতসহ ১০-১২ জন ছেলে বাড়িতে এসে চাঁদার জন্য চাপ দেয়। এসময় গ্রামের লোকজন জড়ো হয়ে তাদের ঘেরাও করে। পরে পুলিশ নিয়ে এসে পুলিশের সহযোগিতায় তারা চলে যায়। পরের দিন সোমবার ২০ অক্টোবর বিকেলে প্রতিদিনের মতো দোকানে কার্যক্রম চলছিল। এদিন রিফাত এসে আবারও ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করছিল। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে রিফাতসহ ১০-১২ জন ছেলে দেশীয় অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে দোকানের ভেতর প্রবেশ করে ভাঙচুর ও আমাকে মারধর করে। এসময় আসামিরা সিসি ক্যামেরা ও কম্পিউটারসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। বাঁধা দিতে এসে আমার ছোট ভাইও রক্তাক্ত জখম হয়।
তিনি আরও বলেন, ঘটনায় সময় দুইজন পুলিশ নিষ্কিয় ভূমিকা পালন করেছে। তারা চেষ্টা করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। তিনি আরো বলেন, ঘটনার পর আমরা থানায় গিয়ে চাঁদাবাজির মামলা দিতে চাইলে পুলিশ চাঁদাবাজি মামলা নিতে রাজি হয়না। পরবর্তীতে হত্যা চেষ্টা মামলা হয়।
হামলার শিকার ফিরোজ কবিবের ভাই একরামুল হক বলেন, বড় ভাইয়ের দোকানের পাশে আমার দোকান। আমার ভাইয়ের ওপর অতর্কিত হামলা দেখে প্রতিহত করার চেষ্টা করি। এসময় তারা আমার মাথায় আঘাত করে। মাথার দুই জায়গায় সেলাই দেওয়া হয়েছে। ঘটনার সময় দুই পুলিশ সদস্য উপস্থিত ছিল। আমরা ভাবছিলাম যে তারা আমাদের সহযোগিতা করবে, কিন্তু তারা সহযোগিতা না করে যখন একজনকে স্থানীয়রা আটক করলো তখন তারা ভিডিও করতেছিল আর তাদের গায়ে যেন কেউ হাত না দেয় সেই জন্য হুমকি দিয়ে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, রাতেও হামলাকারীরা পুলিশ হেফাজতে চলে যায় এবং এখানেও পুলিশ সঙ্গে ছিল। তারা যে পুলিশি সহযোগিতায় আমাদের ওপর আক্রমণ করল আমরা এর সুষ্ঠ বিচার চাই।
স্থানীয় ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম, হাফিজুর রহমান, সিরাজুল ইসলামসহ কয়েকজন বলেন, মারধর করে যখন তারা পালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তাদের মধ্যে থেকে একজনকে ধরে স্থানীয়রা মারধর শুরু করলে ওই মুহূর্তে পুলিশ ভিডিও করতেছিলো। অথচ ঘটনার সময় পুলিশ আশেপাশে থাকলেও কোন পদক্ষেপ নেয়নি। যা খুবই দু:খজনক। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হয়ে দায়িত্বে যে অবহেলা সাধারণ মানুষ হয়ে আমরা কেমনে নিরাপত্তা পাবো। এর সাথে পুলিশের সংশ্লিষ্ট আছে কিনা বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত।
মঙ্গলবার ২৮ অক্টোবর বিকেলে অভিযোগের বিষয়ে জানতে ছাত্রদল নেতা রিফাত হোসেনের সাথে মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন কল কেটে দেন।
এদিন সকালে জানতে চাইলে নওগাঁ জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মামুন বিন ইসলাম দোহা মুঠোফোনে বলেন, বিষয়টি শুনেছি তবে বিস্তারিত জানা নেই। ভুক্তভোগীদের অভিয়োগ দিতে বলা হয়েছে। অভিযোগ পেলে দতন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া কারো ব্যক্তিগত কর্মকান্ডের দায়ভার দল নিবে না।
জানতে চাইলে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো মন্তব্য করতে রাজি না বলে জানান অভিযোগ ওঠা এএসআই মামুনুর রশিদ। তবে রিফাতকে না চেনলেও একসময় তারা পূর্ব পরিচিত এবং হাসপাতালের চিকিৎসাকে কেন্দ্র করে ঘটনা বলে মন্তব্য করেন এই এএসআই।
জানতে চাইলে আত্রাই থানার অফিসার ইনচার্জ মুনসুর রহমান মুঠোফোনে বলেন, পুলিশকে যেকেউ ফোন করে ডেকে নিয়ে যেতে পারে। আর ঘটনার দিন পুলিশ সেখানে ওয়ারেন্টভুক্ত আসামী ধরতে গিয়ে দেখে অনেক মানুষ। পরে পুলিশ গিয়ে দেখে একজনকে আটক করে মারধর করা হচ্ছিল। আর মারধরের শিকার ওই ছেলের যাতে কোন ক্ষতি না হয় সেই জন্য পুলিশ চেষ্টা করেছে। পুলিশের উপস্থিতিতে মারামারির ঘটনা সত্য নয়।
আর চাঁদাবাজির বিষয়ে মামলা না নেওয়ার প্রশ্নে তিনি বলেন, তারা আত্মীয় এবং তাদের সম্পর্কে আগে জানুন।
তারপরও এই ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। আর আমি মিথ্যে মামলা নিইনা। এছাড়া আসামীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালোনো হচ্ছে।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাফিউল সারোয়ার বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সেখানে পুলিশের কোন গাফিলতি থাকলে অবশ্যই আইননুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

আপনার মতামত লিখুন :