আগামী ২০২৬ শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিকের বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে গুরুত্ব দিয়ে স্থান পাচ্ছে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস। এতে গণহত্যাকারী হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে।
একই সঙ্গে পাঠ্যবইয়ে যুক্ত হচ্ছে গত চারটি বিতর্কিত সংসদ নির্বাচনের ইতিবৃত্ত। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পৌরনীতি ও সুশাসন বইয়ের দ্বিতীয় পত্রে ২০০৮ সালের সেনাসমর্থিত পাতানো নির্বাচন, ২০১৪ সালের ভোটের আগেই ১৫৪ আসনে বিজয়ী প্রার্থীদের বিনা ভোটের নির্বাচন, ২০১৮ সালের দিনের ভোট রাতেই বাক্সভর্তি করা এবং ২০২৪ সালের সারাদেশে ডামি নির্বাচনের ইতিবৃত্ত পাণ্ডুলিপিতে যুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এ ছাড়া শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণও সংক্ষিপ্ত আকারে পাঠ্যবইয়ে থাকছে। এ ভাষণ বাদ দেওয়ার প্রস্তাব থাকলেও তা নাকচ করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটি (এনসিসি)। তবে পূর্ণাঙ্গ নয়, সংক্ষেপে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হবে ভাষণটি।
গত সোমবার রাজধানীর মতিঝিলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যবই অনুমোদনবিষয়ক সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়।
বৈঠকে প্রথমে অষ্টম ও দ্বাদশ শ্রেণির বই থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ সরানোর প্রস্তাব করা হয়। শেষ পর্যন্ত আলোচনার মাধ্যমে সংক্ষেপে ভাষণ রাখার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়।
এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী বলেন, অষ্টম শ্রেণির বইয়ে আগেও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল। এবারও তা থাকবে, তবে সংক্ষিপ্ত আকারে। একাদশ শ্রেণির ক্ষেত্রেও একই নীতি প্রযোজ্য হবে।
সভা সূত্র জানায়, নতুন পাঠ্যক্রমে আওয়ামী লীগকেন্দ্রিক অতিবন্দনা বাদ দিয়ে ভারসাম্যপূর্ণ ইতিহাস উপস্থাপন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিকের ইতিহাস, বাংলা দ্বিতীয় পত্র ও পৌরনীতি বইয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার প্রসঙ্গসহ বিতর্কিত নির্বাচনগুলোর প্রকৃত চিত্র সংযোজনের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে।
শুধু বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নয়, পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য বিষয় নিয়েও সভায় ব্যাপক আলোচনা হয়। নবম-দশম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ের ‘আমাদের নতুন গৌরব গাথা’ প্রবন্ধ নিয়ে অভিযোগ ওঠে, জুলাই ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস সেখানে খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
প্রস্তাবকারীরা বলেন, লেখাটিতে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করতে হবে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে গদ্যে ব্যবহৃত শব্দ যেমন– ‘শাসক’, ‘দুর্বৃত্তবাহিনী’, ‘আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা’ পরিবর্তন করে যথাক্রমে– ‘স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা’, ‘আওয়ামী লীগ’ এবং ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী’ করার প্রস্তাব দেন তারা।
এনসিসির একাধিক সদস্য জানান, নবম-দশম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তনের প্রস্তাব এসেছে।
‘রহমানের মা’ গল্পটি বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে। ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’ নাটকটি বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে কটু ভাষার কারণে।
সভায় আরও সিদ্ধান্ত হয়, আগামী শিক্ষাবর্ষে পাঠ্যবইয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের একক ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে ইতিহাস উপস্থাপন করা হবে না।
বিশেষ করে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ইতিহাস, পৌরনীতি ও সুশাসন এবং বাংলা দ্বিতীয় পত্র বইয়ে ব্যাপক সংশোধনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এনসিটিবির পক্ষ থেকে পুস্তক প্রকাশনীগুলোকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে, ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত বিশেষণ ব্যবহার করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন ও ’৭১-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ উপস্থাপনে ভারসাম্য আনতে হবে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি পাঠ্যবইয়ে যুক্ত করতে হবে। আর ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের প্রকৃত চিত্রও পৌরনীতি বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :