ঢাকা সোমবার, ১৪ জুলাই, ২০২৫
পার্সটুডের বিশ্লেষণ

যুদ্ধকালীন নেতৃত্বে যেভাবে সফল হলেন আয়াতুল্লাহ খামেনি

বর্তমান বাংলাদেশ ডেস্ক

প্রকাশিত: জুলাই ১৪, ২০২৫, ০৪:৫৭ পিএম

যুদ্ধকালীন নেতৃত্বে যেভাবে সফল হলেন আয়াতুল্লাহ খামেনি

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। ছবি : সংগৃহীত

সাম্প্রতিক ইসরায়েল-ইরান সংঘাত ভৌগোলিক সীমানা ও সময়ের বিচারে হয়তো দীর্ঘ বা বিস্তৃত যুদ্ধ ছিল না, তবে এটি ইরানের জন্য ছিল এক অগ্নিপরীক্ষা। ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের জন্য যুদ্ধের সময় এবং সংকটকালীন মুহূর্তে নেতৃত্বের দক্ষতা যাচাইয়ের এক বাস্তব মঞ্চে পরিণত হয় এই দ্বন্দ্ব। এই কঠিন বাস্তবতায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি তার বিচক্ষণ নেতৃত্ব, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত এবং সাহসী অবস্থানের মাধ্যমে দেশকে শুধু রক্ষা করতেই সক্ষম হননি, বরং বিজয়ের পথে পরিচালিত করেছেন।

১৩ জুন ভোরবেলায় ইসরায়েল ইরানে আগ্রাসন শুরু করে। লক্ষ্যবস্তু ছিল ইরানের পরমাণু স্থাপনা, সামরিক ঘাঁটি, চিকিৎসাকেন্দ্র, এমনকি তেহরানের এভিন কারাগারও। এ হামলায় ইরানের শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তাসহ বহু সাধারণ নাগরিক শাহাদাত বরণ করেন। কিন্তু সেসব হামলার পরপরই ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হুঁশিয়ারি দিয়ে ঘোষণা করেন, ‘ইরানের জাতীয় নিরাপত্তার ওপর যে কোনো আঘাতেরই কঠোর ও অনুশোচনাজনক জবাব দেওয়া হবে।’

এই প্রেক্ষাপটে তার নেতৃত্ব কীভাবে এক উত্তাল সংকটকে সুবিন্যস্ত প্রতিরোধে রূপান্তর করেছে সেটিই ছিল এ যুদ্ধের প্রধান পাঠ।

দ্রুত সেনা পুনর্গঠন ও পাল্টা জবাব

যুদ্ধের সূচনায় ইরানের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের শহীদ হওয়া সামরিক বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। তবে ইরান সেখানে দেখায় ব্যতিক্রমধর্মী দৃঢ়তা। সর্বোচ্চ নেতা দ্রুত বিকল্প কমান্ড কাঠামো গড়ে তোলেন এবং সরাসরি নতুন কমান্ডারদের নিয়োগ দিয়ে অপারেশনাল নির্দেশনা প্রদান করেন।

মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ইরানি বাহিনী নিজেদের সংগঠিত করে ভয়াবহ পাল্টা হামলা শুরু করে। ক্ষেপণাস্ত্রের টার্গেটে ছিল তেলআবিবের অস্ত্রাগার, সামরিক ঘাঁটি এবং বিমান প্রতিরক্ষা স্থাপনা। এই দ্রুত কার্যকর পাল্টা জবাব সম্ভব হয় দুটি কারণে :

১. পূর্ববর্তী সামরিক মহড়ায় বিকল্প কমান্ড সেন্টারের প্রশিক্ষণ ছিল; ২. খামেনি নিজে সরাসরি সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কের ভূমিকা পালন করেন, যাতে সিদ্ধান্তে দেরি না হয়।

ফলে আধুনিক যুদ্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্রুততা ও বিকেন্দ্রিক বাস্তবায়নের সমন্বয় এই যুদ্ধে ইরানকে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

জনমত পরিচালনায় প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব

সাধারণত যুদ্ধকালীন সময়ে শীর্ষ নেতারা পর্দার আড়ালে থেকে কথা বলেন। কিন্তু খামেনি ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি পুরো সংকটকালে তিনবার সরাসরি জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন, যার প্রতিটি ছিল কৌশলগতভাবে সময়োপযোগী ও দৃঢ় অবস্থানের প্রতিচ্ছবি। তার এই কৌশল জনমনে আস্থা ফিরিয়ে আনে এবং মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে ইরানকে এগিয়ে রাখে।

প্রথম ভাষণটি তিনি দেন সেই মুহূর্তে যখন ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র তেলআবিবে আঘাত হানছিল। একই সঙ্গে সামরিক প্রতিরোধ ও রাজনৈতিক বার্তা একত্রে তুলে ধরে তিনি বৈধ প্রতিরক্ষার যুক্তিকে শক্তিশালী করেন।

দ্বিতীয় ভাষণ আসে ষষ্ঠ দিনে, যখন ইসরায়েল বিচ্ছিন্নভাবে পাল্টা হামলা চালাচ্ছিল। এ সময় তিনি শান্ত কিন্তু দৃঢ় স্বরে জনগণকে আশ্বস্ত করেন, নেতৃত্বে অবিচল থাকার সংকেত দেন। আর তৃতীয় ভাষণে তিনি সরাসরি যুদ্ধবিরতির নামে আত্মসমর্পণের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন, যা ছিল বিদেশি প্রচারণার বিরুদ্ধে একটি শক্ত বার্তা।

এই ধারাবাহিক বার্তাগুলো জনমনে আস্থা জাগিয়ে তোলে, গুজব ও শত্রুপক্ষের তথ্যযুদ্ধকে ব্যর্থ করে দেয়। ইরানিদের মনোবল ভেঙে পড়ার বদলে ঐক্য আরও দৃঢ় হয়।

আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি

ইরানের এই প্রতিরোধ ও খামেনির নেতৃত্ব বিশ্বমঞ্চে প্রশংসা কুড়িয়েছে। আল জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ানসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠে এসেছে, কীভাবে ইরান সীমিত ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে ইসরায়েলকে পিছু হটতে বাধ্য করেছে। সামাজিক মাধ্যমেও খামেনি হয়ে ওঠেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ফলে বিশ্ব জনমতের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশে ইরান ও এর নেতৃত্বের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থন তৈরি হয়।

গুজবের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ : প্রতীকী শক্তি প্রদর্শন

যুদ্ধের পরপরই পশ্চিমা মিডিয়াগুলো খামেনির সম্ভাব্য হত্যার গুজব ছড়াতে থাকে। কিন্তু মহররম উপলক্ষে শোক অনুষ্ঠানে তার সরব উপস্থিতি এসব অপপ্রচারের দাঁতভাঙা জবাব হয়ে দাঁড়ায়। কোনো বক্তব্য না দিয়েও শুধু উপস্থিতির মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেন- ইরান নিরাপদ, স্থিতিশীল এবং তার নেতৃত্ব অটুট।

উপসংহার : নেতৃত্ব যখন আত্মরক্ষার প্রধান অস্ত্র

সাম্প্রতিক যুদ্ধের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে, আয়াতুল্লাহ খামেনির নেতৃত্ব কেবল সামরিক নয় বরং কৌশলগত, মনস্তাত্ত্বিক ও জনসম্পৃক্ততার প্রতিটি স্তরে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। তার নেতৃত্বে ইরান শুধু এক সামরিক আগ্রাসন প্রতিহত করেনি বরং জনমত, আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং প্রতিরোধের নৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলে একটি নতুন প্রতিরক্ষা মডেলের রূপরেখা তৈরি করেছে।

এটাই ছিল ইসরায়েলের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে ইরানের প্রকৃত বিজয় এবং খামেনির নেতৃত্বের বাস্তব সাফল্য।

বর্তমান বাংলাদেশ

Link copied!