টাঙ্গাইলের মাটির ঢেউ, জামালপুরের সীমানার কাছাকাছি, এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে টিকে আছে এক সংগীতের গোষ্ঠী। নাম তাদের ধুয়ার গানের দল। নামের ভেতরেই লুকিয়ে আছে তাদের পরিচয়—‘গানের দল’ অর্থাৎ তারা গান করে দল বেঁধে; কিন্তু এ নামটুকুই তাদের শিল্পের জাদু তুলে ধরতে যথেষ্ট নয়।
কল্পনা করুন, গ্রামের উঠোনে পুরুষ আর নারী মিলে বৃত্তে ঘুরছে, গান আর নাচের তাল একসঙ্গে বুনছে। পায়ে লেগে আছে ধুলো, নিঃশ্বাস উঠছে মিলেমিশে, কণ্ঠে কণ্ঠে জুড়ে যাচ্ছে এক সুর, যা প্রজন্ম পেরিয়ে টিকে আছে। এটা শুধুই গান নয়, এটা এক আচার, উত্তরাধিকার—যেখানে শিল্পী আর তার শিল্প আলাদা থাকে না।
এই দলের গল্পটা হয়তো সে গ্রামেই চাপা পড়ে থাকত, যদি না ঘটত সিনেমার মতো একমুহূর্ত। সংগীত পরিচালক ইমন চৌধুরী একদিন তার বাবার পাঠানো একটি ভিডিওতে প্রথম দেখলেন তাদের। দেখেই বিস্ময়ে বললেন, ‘এভাবে গান হতে পারে—আমি কোনোদিন দেখিনি।’ সেই সরল অথচ টানটান সত্য, শত বছরের ঐতিহ্যের স্পন্দন, তাকে যেন তীব্রভাবে ছুঁয়ে গেল।
ইমন এই সংগীত দলটিকে খুঁজতে গেলেন টাঙ্গাইলে। কিন্তু গিয়ে আবিষ্কার করলেন, এরা মূলত প্রচলিত মঞ্চ বা পেশাদার শিল্পী নন বরং ইটভাটার শ্রমিক। দিনের পর দিন আগুন আর ধোঁয়ার ভেতর কেটে যায় তাদের জীবন। হঠাৎ করে কোক স্টুডিও বাংলার আমন্ত্রণ তাদের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকল। ইমন আগে তাদের কোক স্টুডিওর কাজের ভিডিও দেখিয়ে বোঝালেন, তবু দ্বিধা কাটছিল না। অবশেষে একদিন তিনি সবাইকে ঢাকায় আনলেন। সারা দিন আড্ডা, হাসি, খাওয়াদাওয়া—তারপর জালাল উদ্দীন খাঁর লেখা এবং তার সুর করা গান ‘আসমানে তোর ছায়ারে কন্যা’ শুনিয়ে বললেন, এটাকে ধুয়ার মতো করে গাইতে হবে। বিস্ময়করভাবে কয়েক মুহূর্তেই তারা গানটিকে নিজের মতো করে নিল। প্রথমে রেকর্ড হয়নি, কিন্তু পরে আবার ফিরে এসে এমন এক পরিবেশনা দিল যে, ইমনের কল্পনারও সীমা ছাড়িয়ে গেল।
ইমনের কাছে দলটি ছিল এক অভাবনীয় আবিষ্কার। আর ধুয়ার গানের দলের কাছে ঢাকার হাই-টেক স্টুডিওতে ওঠা ছিল এক অচেনা স্বপ্ন। ইটভাটার ধোঁয়া পেরিয়ে আলো-ঝলমলে মঞ্চে দাঁড়ানো তাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও, কোক স্টুডিওর আন্তরিক আমন্ত্রণ অবশেষে রাজি করাল। খ্যাতির জন্য নয়—ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান দেখাতে।
মঞ্চে ওঠার দিনটা হয়ে উঠল অন্যরকম। আলোকদীপ্ত মঞ্চে শুধু তারাই দাঁড়িয়ে ছিলেন না—সঙ্গে ছিল তাদের গ্রাম, তাদের পূর্বপুরুষ, তাদের প্রজন্মের গান। তাদের কণ্ঠে উঠল এক অদ্ভুত টানে—অমসৃণ অথচ মোহময়, যেন মাটির বুক নিজেই তুলেছে সুর। নাচের পদক্ষেপে ফুটে উঠল শব্দহীন ভাষা, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়ে এসেছে। টাঙ্গাইলের মাটির গন্ধ আর ঢাকার মঞ্চের ঝকঝকে আলো যেন একমুহূর্তে মিলেমিশে গেল। তাদের সুরে আছে অদ্ভুত এক নেশা। সাজানো-গোছানো নয়, অথচ নিখুঁত। একসঙ্গে গাইছে সবাই, অথচ প্রত্যেকের কণ্ঠই আলাদা। মনে হয় গানের সুর ধূপের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, তাল টেনে নিচ্ছে হৃদয়কে বৃত্তের কেন্দ্রে। এ যেন মাটির স্পন্দনই ধরা পড়ছে তাদের গানের ভেতর দিয়ে। ধুয়ার গানের দল আমাদের মনে করিয়ে দেয়, গান আসলে জন্মায় মাটির ভেতর থেকে, মানুষের ভেতর থেকে। চকচকে প্রোডাকশনে নয়, বরং মিলেমিশে ভাগ করে নেওয়া অভিজ্ঞতায়। তারা প্রমাণ করে সংগীত বাঁচে সেখানে, যেখানে আছে হাসির আড্ডা, উঠোনের ধুলো, কিংবা খোলা আকাশের নিচে একসঙ্গে কণ্ঠ মেলানো মানুষের দম।
এ সত্য আরও একধাপ এগিয়ে গেল যখন কোক স্টুডিও বাংলা সিজন-৩ ফিরে আসল তাদের নতুন গান ‘বাজি’ দিয়ে। ধুয়ার গানের দল মঞ্চে উঠল মারমা, বাওম আর মণিপুরী শিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়ে। ফল? শুধু একটি গান নয়, বরং ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মধ্যে এক সেতুবন্ধ। টাঙ্গাইলের সীমানা পেরিয়ে তাদের কণ্ঠ আজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সারা দেশে—জীবন্ত উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে চলেছে তারা।
আপনার মতামত লিখুন :