মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলা শহরে যানজট এখন আর কোনো সাময়িক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়এটি এক ভয়াবহ নিত্যদিনের বাস্তবতা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কুলাউড়া বাজার, চৌমুহনী, স্টেশন রোড, থানা রোড, উপজেলা রোড এবং হাসপাতাল এলাকার রাস্তাগুলো কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে। যানজটের এই স্থবিরতা কেবল সময়ের অপচয় নয়, বরং এটি শহরের অর্থনীতি, জনস্বাস্থ্য ও নাগরিক জীবনের ওপর গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
পৌরসভা ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে ট্র্যাফিক অভিযান, মোবাইল কোর্ট ও উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করা হলেও এর প্রভাব থাকে খুবই অল্প সময়ের জন্য। স্থানীয়দের অভিযোগ, ‘অ্যাকশন’ শেষ হতেই শুরু হয় ‘রিল্যাক্স’, আর শহর ফিরে যায় আগের বিশৃঙ্খলায়।
সরেজমিন পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, কুলাউড়ার ফুটপাতগুলো এখন পথচারীদের হাঁটার জায়গা নয়, বরং দোকানপাট ও পণ্য রাখার গুদামে পরিণত হয়েছে। কুলাউড়া থানার সম্মুখে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাতেও ফুটপাত দখলমুক্ত নয়। ফলে পথচারীরা বাধ্য হয়ে মূল সড়কে হাঁটেন, যা যানবাহনের চলাচলে আরও জট তৈরি করছে। অপরদিকে, রাস্তার পাশে যত্রতত্র পার্কিং ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও সিএনজির বেপরোয়া চলাচল পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে।
জানা গেছে, ট্র্যাফিক বিভাগের সীমিত জনবলও এই সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলছে। মাত্র চারজন ট্র্যাফিক সদস্য দিয়ে পুরো কুলাউড়া শহরের যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ক্রমবর্ধমান যানবাহনের সংখ্যা সামলানো তাদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
আধুনিক ট্র্যাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা না থাকায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণে আনা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যানজটের কারণে শহরের অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনে পড়ছে বহুমাত্রিক প্রভাব। কর্মজীবী মানুষ সময়মতো কর্মস্থলে পৌঁছাতে পারছেন না, ব্যবসায়িক পণ্য পরিবহনে বিলম্ব ঘটছে, শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে দেরিতে পৌঁছাচ্ছে—এতে সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা কমছে। আরও ভয়াবহ দিক হলো, জরুরি রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স যানজটে আটকে পড়ছে, যা অনেক সময় রোগীর জীবন-মৃত্যুর পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে।
একজন পথচারী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “যতদিন অভিযান চলে ততদিন শৃঙ্খলা থাকে, অভিযান শেষ মানেই আবার বিশৃঙ্খলা।” এ অবস্থার কারণে শহরটি যেন এক দুষ্টচক্রের মধ্যে আটকে পড়েছে।
স্থানীয় এক শিক্ষার্থী নিহা চৌধুরী বলেন, “প্রতিদিন সকালে কলেজে যাওয়ার জন্য রিক্সাতে উঠলেই যানজটে আটকে পড়ি। ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই দেরি হয়ে যায়, এতে পড়াশোনায় মনোযোগ কমে যাচ্ছে এবং পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সমস্যা হচ্ছে। প্রশাসনের উচিত এই সমস্যা দ্রুত সমাধান করা, নইলে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যাবে।”
একজন বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা আহসান আলী বলেন, “যানজটের কারণে প্রতিদিন অফিসে পৌঁছাতে দেরি হয়, ক্লায়েন্টদের সাথে মিটিং মিস হয়ে যায়। এতে ব্যাংকের লেনদেনে বিলম্ব ঘটে এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। শহরের ব্যবসায়িক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, প্রশাসনকে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে এই সমস্যা স্থায়ীভাবে সমাধান হয়।”
স্থানীয় নাগরিকরা জানান “শহরটা আমাদের, তাই দায়িত্বও আমাদের।” কুলাউড়ার যানজট সমস্যা শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, এটি সামাজিক দায়িত্ববোধেরও প্রতিফলন। তাই প্রয়োজন নাগরিক সচেতনতা, প্রশাসনিক কঠোরতা ও সমন্বিত উদ্যোগ। এখনই সময়, কুলাউড়াকে একটি আধুনিক, পরিচ্ছন্ন ও সুশৃঙ্খল শহরে রূপান্তরিত করার বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার।
কুলাউড়া থানার ট্রাফিক সাব-ইন্সপেক্টর সুপ্রিয় বলেন, “আমাদের জনবল খুবই সীমিত, মাত্র চারজন সদস্য দিয়ে সারা শহরের ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। তবুও আমরা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি এবং অবৈধ পার্কিং, ফুটপাত দখলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। কিন্তু স্থায়ী সমাধানের জন্য আরও জনবল, আধুনিক সরঞ্জাম এবং নাগরিকদের সহযোগিতা দরকার। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা চেষ্টা করছি, কিন্তু সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পৌর প্রশাসক মোঃ মহিউদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। অফিসে গেলে ‘স্যার ট্রেনিংয়ে’ বলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। মুঠোফোনে এক ডজন কল দিয়েও তিনি রিসিভ করেননি।

আপনার মতামত লিখুন :