ঢাকা রবিবার, ১০ আগস্ট, ২০২৫

নতুন নাকি ধারাবাহিক?; কাদের নেতৃত্বে চলতে চায় জেলা বিএনপির নেতাকর্মী?

নওগাঁ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: আগস্ট ১০, ২০২৫, ০৫:০১ পিএম

নতুন নাকি ধারাবাহিক?; কাদের নেতৃত্বে চলতে চায় জেলা বিএনপির নেতাকর্মী?

জেলা প্রতিনিধি, নওগাঁ:
 

রাত পোহালেই নওগাঁ জেলা বিএনপির দ্বিবার্ষিক সম্মেলন।
সেই সময়ে চলছে প্রার্থীদের দৌড় ঝাঁপ। বসে নেই নিজ নিজ প্রার্থীর সমর্থকেরাও। উদ্দেশ্য একটাই পছন্দের প্রার্থী যেন জয়ের মালা পড়ে।

দীর্ঘ ১৫ বছর পর সোমবার (১১ আগস্ট) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জেলা বিএনপির সম্মেলন। দীর্ঘদিন পর হতে যাওয়া এই সম্মেলনে নেতৃত্বে কারা আসছেন এ নিয়ে তৃনমূল থেকে শুরু করে শহরের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। অনেক নেতাকর্মী ভাবছেন নতুন নেতৃত্ব আসবে, আবার কেউ কেউ ভাবছেন ধারাবাহিক নেতার মধ্যে দুই একজন জয়ী হতে পারেন।

কাজেই সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকের গুরুত্বপূর্ণ পদ কারা পাচ্ছেন, তা নিয়ে চলছে গুঞ্জন। অধিকাংশ নেতাকর্মী দলীয় কার্যক্রমে গতি ফিরিয়ে আনতে নতুন নেতৃত্ব তৈরি করার দাবি জানিয়েছেন।

এর আগে সর্বশেষ দ্বিবার্ষিক এই সম্মেলন হয়েছিল ২০১০ সালে।

এতদিন নানা সীমাবদ্ধতায় সম্মেলন করতে না পারলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বেশ ঘটা করে সম্মেলনের আয়োজন করেছে দলটি। তাই ১৫ বছর পর বিএনপির সম্মেলন ঘিরে পুরো শহর সেজেছে নতুন কমিটির নেতৃত্বে আসা নেতাদের ছবি, ব্যানার, ফেস্টুন আর বিলবোর্ডে। এই সম্মেলন ঘিরে ১৫ বছর হামলা, মামলা, নির্যাতন ও কারাবরনে জর্জরিত নেতাকর্মীরা ফিরে পেয়েছেন প্রাণচাঞ্চল্য। কর্মীরাও মুখে আছেন নতুন নেতৃত্ব বাছাইয়ে।

নেতাকর্মীরা বলছেন, যারা বিএনপির রাজনীতিতে রাজপথে ছিলেন, রাজপথ থেকে উঠে এসেছেন, রাজনীতিতে যাদের দলীয় পরিচয় বেশি, যারা কর্মী বান্ধব তারাই আসুক নেতৃত্বে। দলের দুর্দিনে যারা ত্যাগ স্বীকার করেছেন, নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন তারা যেন সঠিক মূল্যায়ন পান। এছাড়াও সম্মেলনের মধ্য দিয়ে নতুন করে দলকে পুনরুজ্জীবিত ও সুসংগঠিত করে আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে বিজয়ী করতে ভূমিকা রাখবে এমন নেতৃত্ব চান নেতাকর্মীরা।

সোমবার নওগাঁ কনভেনশন সেন্টারে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। দীর্ঘ অপেক্ষার এই সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যোগ দেবেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি নতুনভাবে দল পরিচালনার পাশাপাশি নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেবেন।

দলীয় সুত্রে জানা যায়, সর্বশেষ ২০১০ সালে জেলা বিএনপির দ্বিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে কাউন্সিলরদের ভোটের মাধ্যমে সভাপতি নির্বাচিত হন সামসুজ্জোহা খান, সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম এবং সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন মামুনুর রহমান রিপন। ২০১৫ সালে ওই কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার পর সম্মেলনের মাধ্যমে আর কোনো কমিটি গঠন হয়নি।

সর্বশেষ ২০২২ সালে আবু বক্কর সিদ্দিক নান্নুকে আহ্বায়ক ও বায়েজিদ হোসেন পলাশকে সদস্য সচিব করে গঠিত আহ্বায়ক কমিটির মাধ্যমে জেলা বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছিল।

গত ২৪ জুলাই ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বশীল নেতাদের এক সভায় ১১ আগস্ট নওগাঁ জেলা বিএনপির সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। সম্মেলনের ঘোষণা আসার পরই সরব উঠে জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা। পদপ্রত্যাশী নেতারা ফেসবুকসহ নানা মাধ্যমে প্রচারের পাশাপাশি দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কাছে দৌড়ঝাঁপ করছেন।

এদিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুসারে, এ সম্মেলন উপলক্ষে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়। গত রোববার (৩ আগষ্ট) তফসিল ঘোষণা করেন সম্মেলন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী ও বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা। পরের দিন সোমবার জেলা বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক এই দুইটি পদপ্রত্যাশী প্রার্থীদের মধ্যে মনোনয়নপত্র বিতরণ করা হয়। একই দিনে মনোনয়নপত্র জমা, যাচাই-বাছাই ও চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করা হয়।

সভাপতি পদপ্রত্যাশীরা হলেন- জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নজমুল হক সনি, জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ধলু, জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবু বক্কর সিদ্দিক নান্নু, জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক মাষ্টার হাফিজুর রহমান, জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদ হাসান তুহিন, পৌর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবদুস শুকুর, জেলা বিএনপির সাবেক কোষাধ্যক্ষ এস এম মামুনুর রহমান ও জেলা বিএনপির সাবেক সদস্য এ বি এম আমিনুর রহমান।

সাধারণ সম্পাদক পদ পাওয়ার জন্য লড়ছেন চারজন। তারা হলেন- জেলা বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব বায়েজিদ হোসেন পলাশ, জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মামুনুর রহমান রিপন, জেলা বিএনপির সাবেক  যুগ্ম আহ্বায়ক শহিদুল ইসলাম ও আমিনুল হক বেলাল। এবং সাংগঠনিক সম্পাদকের দুটি পদের জন্য আটজন মনোনয়ন তুলেছেন। তারা হলেন শফিউল আজম (ভিপি) রানা, নূর-ই আলম, ফরিদুজ্জামান, খায়রুল আলম, শবনম মোস্তারী, সুলতান মামুনুর রশিদ, কামরুজ্জামান কামাল ও জহুরুল হক।

কাউন্সিলে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং দুটি সাংগঠনিক সম্পাদক পদে জেলার ১৪টি ইউনিটের ১ হাজার ৪১৪ ভোটার গোপন ব্যালটে জেলা বিএনপির নেতৃত্ব নির্ধারণ করবেন। এতে কাউন্সিলরদের গুরুত্ব বেড়েছে।

একদম গুরুত্বপূর্ণ পদে নতুন সভাপতি প্রার্থী মাসুদ হাসান তুহিন বলেন, আমি দলের ও নেতাকর্মীদের জন্য একটা কনসেপ্ট নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি। সেক্ষেত্রে জয়ী হই আর পরাজয় বরণ করি আমার কোন আপসোস থাকবে না। আমি যে কনসেপ্ট নিয়ে নেমেছি সেটা তৃণমূল নেতাকর্মীদের নিয়ে পালন করে যাব।

সভাপতি প্রার্থী জাহিদুল ইসলাম বলেন, নির্বাচন নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ করা যাচ্ছে। ফ্যাসিবাদী শাসনামলে সব আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছি। সর্বশেষ দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে আমি ভোটের মাধ্যমে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলাম। এবারও আমি আশাবাদী, কাউন্সিলররা ভোটের মাধ্যমে আমাকে বিজয়ী করবেন।

আরেক সভাপতি প্রার্থী নজমুল হক বলেন, বিএনপি যে একটি গণতান্ত্রিক দল, এই নির্বাচনই তার প্রমাণ। নেতা-কর্মীরা প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে তাঁদের নেতা নির্বাচনের সুযোগ পাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ শাসনামলে প্রতিকূল পরিবেশেও আমি তিনবার নওগাঁ পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হয়েছি। সব সময় দলের নেতা–কর্মীদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। জয়ের ব্যাপারে আমি আশাবাদী।

সভাপতি প্রার্থী আবু বক্কর সিদ্দিক নান্নু বলেন, ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনে হারজিত মেনেই আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি। আশা করি, জয়ী–পরাজিত সবাইকে নিয়েই চলতে হবে।

সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী মামুনুর রহমান রিপন বলেন,
আমি ছাত্রদল করে রাজপথে থেকে উঠে এসেছি। অনেক সময় দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছি। ঢাকায় গ্রেপ্তার হয়ে রিমান্ডে ছিলাম। অনেক নির্যাতন সহ্য করেছি। তবুও বিএনপির রাজনীতি থেকে পিছ পা হয়নি। শহীদ জিয়াউর রহমানের আদর্শ বুকে ধারণ করে ১৭ বছর ধরে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছি।

তিনি বলেন, ৯৯টি ইউনিয়নের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা জানে আমি যখন থেকে ছাত্রদলের নির্বাচিত সভাপতি ছিলাম তখন থেকেই তাদের সাথে আমার যোগাযোগ। তাই জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা চান নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হোক। সেই জায়গা থেকে তিনি সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হয়েছেন। আশা করছেন, কাউন্সিলররা দলের প্রতি প্রার্থীদের ত্যাগ-তিতিক্ষা বিবেচনা করে তাঁদের নেতা নির্বাচিত করবেন। আর আমি নির্বাচিত হলে আগে যেমন তৃণমূল নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে দলকে সুসংগঠিত করেছি ভবিষ্যতেও সেটাই করবো।

আরেক সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী বায়েজিদ হোসেন বলেন, সদস্য সচিবের দায়িত্ব পাওয়ার পর নওগাঁ জেলা বিএনপিকে একটি শক্তিশালী ইউনিটে পরিণত করেছি। ইউনিয়ন থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত সব কমিটি গণতান্ত্রিক উপায়ে গঠন করা হয়েছে। সাংগঠনিক কার্যক্রম এবং বিগত হাসিনা শাসনামলে জেল জুলুমের ইতিহাস বিবেচনা করে আশা করি সম্মানিত কাউন্সিলররা আমাকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচন করবেন।

সম্মেলন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী ও বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা বলেন, সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ ভোটে এই তিনটি পদে নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে। নওগাঁ কনভেনশন সেন্টারে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে যুক্ত হবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এছাড়া দলের স্থায়ী কমিটি ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যরা বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। সম্মেলন সফল করার জন্য ইতিমধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।

সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী মামুনুর রহমান রিপনের সমর্থক রাণীনগর উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মেজবা উল হক লিটন বলেন, আমি বিশ্বাস করি তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা ত্যাগি ও নির্যাতিত নেতৃত্ব ঠিক করবে। সেক্ষেত্রে মামুনুর রহমান রিপন অনেক এগিয়ে। কারণ সে রাজপথ থেকে উঠে আসা নির্যাতিত এক নেতা। এবং দলের তৃণমূলের সাথে সে সবসময় যোগাযোগ রক্ষা করে। মামুন নির্বাচিত হলে জেলা বিএনপিকে সুসংগঠিত রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

উল্লেখ, এদিকে এই সম্মেলনের আগের দিন রোববার (১০ আগস্ট) দুপুর ২টায় নওগাঁ জেলা প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে সম্মেলনের কাউন্সিলর বা ভোটার তালিকাকে ‘বিতর্কিত’ উল্লেখ করে সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে  প্রার্থীতা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি নেতা আমিনুল ইসলাম বেলাল।
 

বর্তমান বাংলাদেশ

Link copied!