ঢাকা রবিবার, ১০ আগস্ট, ২০২৫

৩৭ বছর পর ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে কিশোরগঞ্জের নাজমুলের সাঁতারুর ইতিহাস

মো.ওমর সিদ্দিক রবিন, কিশোরগঞ্জ

প্রকাশিত: আগস্ট ৯, ২০২৫, ০৬:১৪ পিএম

৩৭ বছর পর ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে কিশোরগঞ্জের নাজমুলের সাঁতারুর ইতিহাস

ছবি- বর্তমান বাংলাদেশ।

কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি : কিশোরগঞ্জের হাওর অধ্যুষিত নিকলীতে পানির সঙ্গে বেড়ে ওঠা যুবক ছোটবেলার লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন।
দীর্ঘ ৩৭ বছর পর বিশ্বখ্যাত ইংলিশ চ্যানেল সাঁতরে জয় করলেন বাংলাদেশের এক সাহসী সন্তান, কিশোরগঞ্জের নিকলীর কৃতি তরুণ নাজমুল হক হিমেল। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে আবারও লেখা হলো গর্বের নতুন অধ্যায়।

এই চ্যানেল জয় শুধু একটি ব্যক্তির নয়, এটি একটি জাতির অর্জন। বহু প্রতীক্ষিত সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিলেন হিমেল। তার এ সাফল্য পুরো জাতিকে গর্বিত করেছে।

গত (২৯ জুলাই) যুক্তরাজ্যের সময় বিকেল ৩টায়
এই দুরূহ চ্যালেঞ্জে অংশ নিয়ে সফলভাবে ৩৩.৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেন হিমেল। গলায় পরেন ইংলিশ চ্যানেল জয়ের মালা।

ইংলিশ চ্যানেল হলো যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মধ্যবর্তী সমুদ্রপ্রণালী। এই প্রণালীর দূরত্ব ৩৩ দশমিক ৮ কিলোমিটার। এটি সাঁতরে পাড়ি দিয়েছেন নাজমুল হক হিমেল। ১৯৮৭ সালে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছিলেন আরেক বাংলাদেশি মোশাররফ হোসেন।  

স্থানীয় ও নিকলী সুইমিং ক্লাব সূত্রে জানা গেছে,
কিশোরগঞ্জের নিকলী মীরহাটি গ্রামে জন্ম নাজমুল হক হিমেলের হাওরেই বেড়ে ওঠা।
১৯৯৭ সালে বাবা আবুল হাসেমের মাধ্যমে সাঁতারে হাতেখড়ি। আবুল হাসেম ছিলেন আশির দশকের জাতীয় সাঁতারু। জাতীয় সুইমিং ফেডারেশনের সাবেক সদস্য ও নিকলী সুইমিং ক্লাবের কোচ।

চার ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয় হিমেল। সাঁতারুর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাঁতারে হাতেখড়ি সাবেক সাঁতারু মোঃ সোলায়মানের মাধ্যমে ১৯৯৮ সালে। তারপর জাপানি কোচের অধীনে ছিলেন তিন বছর। পরের সময়টুকু চীনা কোচের অধীনে। সাঁতারের পথচলায় সব মিলে ১০ বছর এই তিনজনের অধীনেই ছিলেন হিমেল।

এ সময়ের মধ্যে ১৯৯৮ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে জাতীয় বয়সভিত্তিক সাঁতারে ২০টি স্বর্ণ, ১৫টি রৌপ্য পদক নিজের ঝুলিতে পুরেছেন এই সাঁতারু। ২০০৬ সালে বয়স গ্রুপে নির্বাচিত হয়েছেন সেরা সাঁতারু। ২০০৬ থেকে ২০০৮ সালে জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় অর্জন পাঁচটি স্বর্ণ ও চারটি রৌপ্যপদক। এই সময়কালে বয়সভিত্তিক সাঁতারে গড়েছেন ছয়টি জাতীয় রেকর্ড। ২০০৮ সালে ঢাকায় দ্বিতীয় ইন্দো-বাংলা গেমসে এক স্বর্ণ ও দুই রৌপ্য জয় করেন।

আরও জানা যায়, বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিকেএসপি থেকে ২০০৬ সালে এসএসসি ও ২০০৮ সালে এইচএসসি পাস করার পর হিমেল উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান চীনে। সেখানে বেইজিং স্পোর্টস ইউনিভার্সিটি থেকে ২০০৯-২০১৩ সেশনে শারীরিক শিক্ষায় স্নাতক ডিগ্রি লাভকরেন। একই বিষয়ে ২০১৩-২০১৬ মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। এই সময়ের মধ্যে অল বেইজিং ইন্টারন্যাশনাল ফরেন স্টুডেন্টস সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপ ২০১২-তে চ্যাম্পিয়ন, ২০১২ ও ১৩ সালে ৮০০ মিটার ওপেন ওয়াটার চ্যাম্পিয়নশিপ কুনমিং, চীনে এক স্বর্ণ এক রৌপ্য জয় করেন।

চীনে তিনি সাঁতারে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানে দীর্ঘদিন কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তখন থেকেই তার একটি মাত্র লক্ষ্য ছিল ইংলিশ চ্যানেল জয়ের স্বপ্ন, যেটি বিশ্বব্যাপী একজন সাঁতারুর জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত। আর সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে সফল হয়েছেন। বাংলাদেশি সাঁতারু হিসেবে ৩৭ বছর পর ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমের কীর্তি গড়লেন তিনি । এর আগে ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশি সাঁতারু মোশাররফ হোসেন ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেন। ১৯৬৫ সালে আবদুল মালেক চ্যালেঞ্জ জয় করেন। তাদের আগে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত তিন বছরে ছয়বার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেন সাঁতারু ব্রজেন দাস। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার কীর্তি গড়েন তিনি।

হিমেল গত কয়েক বছর ধরে প্রস্তুতি শেষে এক ঐতিহাসিক অভিযান ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে নিজের স্বপ্ন পূরন করেছেন ।

জাতীয় পর্যায়ে স্বর্ণজয়ী সাঁতারু নাদিমুল হক বলেন, হিমেল ভাই আমাদের অনুপ্রেরণা। আমরা চাই, তার মতো একদিন আন্তর্জাতিক মানের সাঁতারু হতে।

সাঁতার প্রতিযোগিতায় জাতীয় পর্যায়ে স্বর্ণপদক জয়ী জল কন্যা পুষ্প আক্তার বলেন, সাঁতারুদের জন্য ভীষণ চ্যালেঞ্জিং ইভেন্ট ইংলিশ চ্যানেলে নানা প্রতিকূলতায় সাঁতার কাটা। বাংলাদেশ হতে ৩৭ বছর পর ইংলিশ চ্যানেল সাঁতার কেটে আজকে সফল আমাদের হাওরাঞ্চলের সন্তান হিমেল।

নিকলী সুইমিং ক্লাবের প্রশিক্ষক জুবায়ের আহমেদ বলেন, এই নিকলী থেকে বেরিয়ে আসছে দেশসেরা অনেক সাঁতারু, যাদের অনেকের গলায় ঝুলেছে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পদক। তিনি ভারাক্রান্ত হয়ে বলেন, হিমেল নিজস্ব অর্থায়নে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছে, এটায় কোন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্পন্সর করেনি। নাজমুল হক হিমেল আমাদের গৌরব, ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ের মাধ্যমে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি করেছেন। এই কঠিন পরিক্ষায় সফল হতে আজ স্বপ্ন পূরন করে ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন।

বিজয়ের অনুভূতি শেয়ার করে নাজমুল হক হিমেল  বলেন, আমি সত্যিই অনেক অনেক আপ্লুত। এ অনূভুতি বোঝানোর ভাষা ঠিক এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই। ছোট একটা মেডেল কিন্তু এর ওজন এত "ভারী" যা আমার অনূভুতির বাইরে। ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন ছিল। সেটি জয়ের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আটলান্টিক মহাসাগরে সাঁতার কাটতে নামার আগে অনেক গবেষণা করেছেন। সবচেয়ে বড় বাধা ছিল ঠান্ডা পানি, জেলিফিশ ও সি সিকনেস। জেলিফিশ দেখে কিছুটা ভয় লেগেছিল। কারণ, সংস্পর্শে লাগলে চামড়ার সঙ্গে লেগে যেত। এটি খুবই রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা ছিল।

তিনি বলেন, আমার সঙ্গে বাংলাদেশের আরেক সাঁতারু মাহফিজুর রহমান (সাগর) ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন। আমাদের লাস্ট ফিনিশিং ম্যান ছিল মাহফিজুর রহমান। যখন বোট থেকে হুইসেল দিল, সে ক্লিয়ার। আমাদের মধ্যে তখন যে কী উল্লাস, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।

তিনি বলেন, ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে একজন সাঁতারুর ১০ লাখ টাকার মতো খরচ হয়। আমাকে বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইনস আসা যাওয়ার টিকেট স্পন্সর করেছিলেন।


নিকলী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রেহানা মজুমদার বলেন, নাজমুল হক হিমেলের এই অর্জন শুধু নিকলীর নয় এটা দেশবাসীর গর্ব। আসলে নিকলীতে কোনো সুইমিংপুল নেই। উপজেলা পরিষদের পুকুরেই ছেলেরা সাঁতার শিখছে। নাজমুলের বিজয় বিশ্বের বুকে লাল-সবুজের পতাকার সম্মান ও হাওর এলাকার সুনাম বাড়িয়েছে। আত্মবিশ্বাস ও কঠোর পরিশ্রমে তিনি বিশ্ব জয় করেছেন। তার পথ ধরে হাওরে আরও খ্যাতিমান সাঁতারু তৈরি হবে। আমরা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে খুব দ্রুতই সাঁতারুদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

প্রসঙ্গত, নিকলীতে সাঁতারু তৈরির ইতিহাসে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়া নাজমুল হক হিমেলের বাবা জড়িয়ে রয়েছেন।

পিতা আবুল হাশেম সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্থানীয় এক সাঁতার প্রতিযোগিতায় বড়দের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে চ্যাম্পিয়ন হন। সে সময় তার নাম ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। এরপর আবুল হাশেমের পিছনে থাকাতে হয়নি,সেসময় তিনি বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে থাকেন। ১৯৭৫ সালে জাতীয় পর্যায়ে একটি রৌপ্য, ১৯৭৭ সালে জাতীয় পর্যায়ে দুটি রৌপ্য এবং একই সালে ঢাকা বিভাগীয় আঞ্চলিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় পাঁচটি স্বর্ণ জিতলেন।

পিতা আবুল হাসেম ও তার দুই ভাই আছে তারাও সাঁতারু। তাদের সন্তানেরাও সাঁতারু। পারিবারিকভাবে  সবাই সাঁতারু।

নিকলীর মধ্যে আবুল হাশেমই সাঁতার কেটে প্রথম সাফল্য পান। শুরুর দিকে তাকে দেখেই স্থানীয় অনেকেই সাঁতারে আসতে থাকলেন। আর ১৯৯৩ সালে কারার মিজান সাফ গেমসে স্বর্ণপদক জেতার পর সেটা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। 

বর্তমান বাংলাদেশ

Link copied!