ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই, ২০২৫

বাংলা ব্লকেড, অবরোধ বিক্ষোভে উত্তাল ছিল দেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: জুলাই ৮, ২০২৫, ১২:১২ পিএম

বাংলা ব্লকেড, অবরোধ বিক্ষোভে উত্তাল ছিল দেশ


   

সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে শিক্ষার্থীদের ডাকে ব্যাপক অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছিলেন দেশের সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা। ৮ জুলাই তারা ‘বাংলা ব্লকেড’ নামে রাজধানীর ১১টি মোড় এবং এক স্থানে রেলপথ অবরোধ করেন। আগের দিন তারা সাতটি স্থানে কর্মসূচি চালিয়েছিলেন। অবরোধের কারণে রাজধানীর বড় অংশে যোগাযোগব্যবস্থা প্রায় বন্ধ হয়ে পড়েছিল।

রাজধানীর বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, সাভার, গোপালগঞ্জ, বরিশাল, কুষ্টিয়া, রংপুর ও কুমিল্লার মতো কমপক্ষে ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রেলপথ ও মহাসড়ক অবরোধ করেছিলেন। আন্দোলনটি ছিল ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নাম নিয়ে।

 

রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে অবরোধ তুলে নেওয়ার আগে আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম নতুন কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেন।

নাহিদ জানান, অর্ধবেলা নয়, একটি সর্বাত্মক ব্লকেডের পরিকল্পনা ছিল। পরবর্তী দিনে সারা দেশে শিক্ষার্থী ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় এবং গণসংযোগ করা হয়। ক্লাস বর্জন ও ধর্মঘট কর্মসূচিও চলেছিল। তিনি জানান, পরদিনের অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে নতুন কর্মসূচি প্রকাশ করা হয়।

নাহিদ বলেন, চার দফা দাবির বদলে একমাত্র দাবিই ছিল সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডের কোটা বাতিল করা, কেবল সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম কোটা রেখে সংসদে আইন পাস করা। তিনি বলেন, সরকারই বিষয়টি ঠিক করতে পারে, আর আদালতের মাধ্যমে সমাধান সম্ভব নয়।

তারা ৬৫ সদস্যের সমন্বয়ক দল গঠন করেছিলেন। নাহিদ জানান, তারা দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে শিক্ষার্থীদের বাধা বা হয়রানির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন।

সেদিন আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শহরের বিভিন্ন মোড় অবরোধ করে অবস্থান নিয়েছিলেন। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, বরিশাল, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় রংপুর, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন সড়ক, রেলপথ অবরোধ করেছিলেন।

সরকার ও আওয়ামী লীগ শিক্ষার্থীদের দাবিকে যৌক্তিক মনে করলেও আন্দোলনকে অযৌক্তিক হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন।

এর আগের দিন (৭ জুলাই) ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে শিক্ষার্থীরা ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করেন। ওইদিন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ, ধর্মঘট এবং ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেন হাজার হাজার শিক্ষার্থী। বিকাল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করে রাখেন। এতে পুরো রাজধানী স্থবির হয়ে পড়ে।

কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে সায়েন্স ল্যাব, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, চানখাঁরপুল, আগারগাঁও, কারওয়ান বাজারসহ ঢাকা শহরের নানা এলাকায় ছাত্রদের সড়ক অবরোধে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শাহবাগ থেকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল পর্যন্ত মিছিল করেন আন্দোলনকারীরা। বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থীরা ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘একাত্তরের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’প্রভৃতি স্লোগান দেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী জমায়েত হয়ে মিছিল করেন এবং পরে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে বিদেশি অতিথিবাহী মাইক্রোবাস আটকে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। বিকালে চানখাঁরপুল, সায়েন্স ল্যাব, আগারগাঁও, নীলক্ষেতসহ বিভিন্ন স্থানে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

সংগঠনটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জানান, তারা শাহবাগ থেকে ফার্মগেট অতিক্রম করার কর্মসূচি নিয়েছিলেন এবং কোনো হলে বাধা এলে সম্মিলিতভাবে হল ঘেরাও করা হবে বলে ঘোষণা দেন। শিক্ষার্থীরা জানান, দাবি না মানলে তারা আরো কঠোর কর্মসূচি দেবেন।

চার দফা দাবির মধ্যে ছিল আগের পরিপত্র বহাল রেখে একটি কমিশন গঠন করে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করা, অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য যৌক্তিক ও ন্যূনতম কোটা রাখা, কোটায় যোগ্য প্রার্থী না থাকলে মেধাতালিকা থেকে পদ পূরণ, একাধিকবার একই কোটা ব্যবহার না করা ও দুর্নীতিমুক্ত নিয়োগ নিশ্চিত করা।

একই দিন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে যুব মহিলা লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বলেন, কোটার বিষয়টি এখন আদালতে বিচারাধীন এবং আদালতের রায় উপেক্ষা করে আন্দোলন চালানো সঠিক নয়। তিনি প্রশ্ন তোলেন- যারা কোটা আন্দোলন করছে, তাদের মধ্যে কতজন পিএসসি পরীক্ষায় বসেছে এবং উত্তীর্ণ হয়েছে?

হাসিনা বলেন, আগে কোটা থাকার কারণে মেয়েরা বেশি সুযোগ পেত; কিন্তু এখন সে সুযোগ তারা হারাচ্ছে। কোটার কারণে পিছিয়ে থাকা জেলা ও জনগোষ্ঠীও চাকরি পাচ্ছে না। তিনি জানান, হাইকোর্টের রায় মেনে চলাই সরকারের অবস্থান এবং আন্দোলনের নামে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা থেকে দূরে রাখা যৌক্তিক নয়।

এদিনের ঘটনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়- আন্দোলন বিস্তৃত, সাংগঠনিক ও দাবি সুসংহত হলেও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, মিডিয়া বিভ্রান্তি এবং সরকারের চাপ, সব মিলিয়ে আন্দোলনকারীরা এক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন।

পরবর্তী দিনগুলোয় আন্দোলনের ধারা একটি নতুন মাত্রা পায়। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় ‘আমি কে, তুমি কে- রাজাকার রাজাকার স্লোগান সংবলিত একটি ব্যানার সামনে আসার পর আন্দোলনকারীরা দ্রুত ও দৃঢ় প্রতিক্রিয়া জানান। তারা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন, এই আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় নয়, বরং এটি একটি স্বাধীন, স্বতঃস্ফূর্ত ও ছাত্র-জনতার যৌক্তিক দাবির সংগ্রাম। আন্দোলনকারীদের এ ধরনের স্পষ্ট অবস্থান প্রমাণ করে, তারা বিভ্রান্তি ও ষড়যন্ত্রের ঊর্ধ্বে থেকে একটি ন্যায়সংগত, গণতান্ত্রিক ও গণমানুষের আন্দোলন গড়ে তুলতে সংকল্পবদ্ধ।

২০১৮ সালের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সরকার প্রথম শ্রেণির চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করেছিল; কিন্তু শিক্ষার্থীরা সেই পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যান। সরকারের মধ্যে কোটা সংস্কারের বিষয়েও আলোচনা চলছিল এবং কিছু সীমিত কোটা রাখা হতে পারে বলে জানা গিয়েছিল।

অপরদিকে, আদালতের আপিল বিভাগের শুনানি ৪ জুলাই মুলতবি করা হয় এবং সরকার আপিল বিভাগে শিক্ষার্থীদের পক্ষে আইনজীবী রেখেও শুনানিতে অংশ নিতে উৎসাহিত করেছিল।

সার্বিকভাবে ৮ জুলাই শিক্ষার্থীরা ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় রেলপথ ও মহাসড়ক অবরোধসহ বিক্ষোভ চালিয়েছিল, যা দেশব্যাপী কোটা সংস্কার ও সরকারি চাকরিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে রয়ে গেল।

 

বর্তমান বাংলাদেশ

Link copied!