মামলা হচ্ছে একের পর এক, তবুও কমছে না মাদক কারবার। বরং মাদকের সাম্রাজ্য ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে। সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাটের পরিস্থিতি যেন আরও ভয়াবহ—যেখানে একজন বর্তমান ইউপি সদস্যের নামেই রয়েছে ১৪টি মাদক মামলা! তাঁর স্ত্রী-ছেলেরাও যুক্ত এই কারবারে। জেলার ছোট একটি ইউনিয়নেই প্রায় শতাধিক ‘আলীশান’ বাড়িওয়ালা মাদক ব্যবসায়ী। এসব গ্রামে আত্মীয়তা করতেও ভয় পাচ্ছেন মানুষ, গাঁয়ের বদনামে ভেঙে যাচ্ছে কত ছেলে-মেয়ের বিয়ে!
এমনকি সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে মাদক কারবারিরা এখন শুধু ব্যবসা করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, বরং প্রশাসনের মাদকবিরোধী অভিযান স্তব্ধ করতে শুরু করেছে `প্রোপাগান্ডা`! শতাধিক তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীর দাপটে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। বড় ডিলারদের নেটওয়ার্ক ভাঙতে গিয়ে উল্টো তাদের আইনি হয়রানির অপচেষ্টার মুখে পড়ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের পরও মাদক পাচার দমন না হওয়ার পেছনে রয়েছে এই শক্তিশালী চক্রের নিত্যনতুন কৌশল।
প্রশাসনের দফায় দফায় অভিযান আর কঠোর অবস্থান নিয়েও লালমনিরহাটের সীমান্ত গ্রামগুলোতে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে কালীগঞ্জ উপজেলার গোড়ল ও চন্দ্রপুর ইউনিয়নে মাদকের নেটওয়ার্ক রীতিমতো দুর্ভেদ্য। এটি থানা থেকে দূরে হওয়ায় ২০২১ সালে গোড়লে একটি তদন্ত কেন্দ্র তৈরি করা হলেও শুরুতে আওয়ামী লীগের তদবিরে পুলিশ বিশেষ সফল হতে পারেনি। তবে সম্প্রতি ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর গোড়ল তদন্ত কেন্দ্র কঠোর অবস্থানে যাওয়ায় মাদক ব্যবসায়ীরা কিছুটা চাপে পড়েছে। গত এক বছরে তদন্ত কেন্দ্রটি বিগত দুই বছরের দ্বিগুণেরও বেশি সফলতা পেয়েছে।
লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার গোড়ল ইউনিয়নের বর্তমান ইউপি সদস্য নুরুল আমিন বাদশার নামেই রয়েছে ১৪টি মাদক মামলা। শুধু তিনি নন, তাঁর স্ত্রী স্বপ্না এবং একমাত্র ছেলে শাহীনের নামেও ২টি করে মাদক মামলা ঝুলছে। বাদশার ভাইদের নামেও রয়েছে মামলা। ২০২২ সালে "ইউপি সদস্য বাদশা`র বাড়িতে ফেন্সিডিলের বার" শিরোনামে ভিডিওসহ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েও জামিনে বেরিয়ে এসে তারা দাপিয়ে ব্যবসা করে চলেছে। বাদশা নিজে স্বীকার করেছেন, তিনি একসময় মাদক ব্যবসা করতেন, তবে এখন ছেড়ে দিয়েছেন বলে দাবি করেন।
এছাড়াও, গোড়ল ইউনিয়নে মোফা মিয়া, দুলাল ওরফে ঘুগরি দুলাল, রহিম বাদশা, নান্নু মিয়ার মতো দুর্ধর্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা রয়েছে, যাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা বিচারাধীন। সাবেক ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলাম, মতিন, হযরত বেলাল হোসেন বুড়াসহ আরও অনেকে বড় ডিলার হলেও অনেকের বিরুদ্ধে মামলা নেই। কেবল গোড়ল ইউনিয়নেই এমন প্রায় শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে।
শূন্য থেকে কোটিপতি: ‘মাদকের গ্রাম’ আতঙ্ক
ফেন্সিডিল, ট্যাপেন্টা, গাঁজা, ইয়াবা, ভারতীয় মদ, স্কাপ—সব ধরনের মাদকের নিরাপদ রুট এখন এই এলাকা। মাদক পাচার ও বিক্রি করে রাতারাতি কোটিপতি হয়েছেন এসব ডিলাররা। গড়ে তুলেছেন আলিশান বাড়ি, কিনেছেন দামি গাড়ি আর জমি।
স্থানীয়রা জানান, হাতে নাগালে মাদক পাওয়ায় নষ্ট হচ্ছে যুবসমাজ। এই মাদক কারবারিদের কারণে এসব গ্রাম এখন ‘মাদকের গ্রামে’ পরিণত হয়েছে। আতঙ্কের এই গ্রামে কেউ আত্মীয়তা করতেও চান না। গ্রামের নামের বদনামে অনেক ছেলে-মেয়ের বিয়েও ভেঙে যাচ্ছে।
স্থানীয় অরন্য স্কুল অ্যান্ড কলেজের নির্বাহী পরিচালক আনজুরুল হক সরকার মিন্টু বলেন, "গুটি কয়েক মাদক ব্যবসায়ীর কারণে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। গ্রামগুলোর নামের সঙ্গে মাদকের ট্যাগ পড়ে যাওয়ায় অনেকের বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে।"
স্থানীয়রা মাদক নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন। কৃষক তমিজ উদ্দিনের অভিযোগ, মাদক ব্যবসায়ীরা রাতের আঁধারে চোরাচালানের জন্য জমির ফসল নষ্ট করে। এখন শীতকালে মাদকের সঙ্গে গরুও পাচার করবে।
গোড়ল তদন্ত কেন্দ্রর ইনচার্জ এসআই মোস্তাকিন জানান, যোগদানের এক বছরে তিনি ৭০ জনকে গ্রেপ্তার ও ৬৮টি মামলা করেছেন। মাদক কারবারিদের কাছ থেকে নানান হুমকি ও হেনস্তার শিকার হলেও তিনি মাদকের সঙ্গে কোনো আপস করবেন না।
কালীগঞ্জ থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাকির হোসেন বলেন, "মাদক নিয়ন্ত্রণে অভিযান চলবেই। সীমান্তের গ্রামে মাদকের ট্যাগ রোধে অভিযান জোরদার করা হচ্ছে। মাদক ব্যবসায়ীদের কোনো চক্রান্তই সফল হবে না। সিনিয়র অফিসারের নির্দেশে অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে।"
তবে, আইনের ফাঁক গলে গ্রেপ্তারকৃতরা দ্রুত জামিনে বেরিয়ে আসায় পাচার দমন করা কঠিন হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে।
আপনার মতামত লিখুন :