ঢাকা শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২৫

ডিডির রাজ্যে কর্মচারীরা প্রজা! দুর্নীতিতে টইটম্বুর কিশোরগঞ্জ পরিবার পরিকল্পনা দপ্তর

মো.ওমর সিদ্দিক রবিন, কিশোরগঞ্জ

প্রকাশিত: অক্টোবর ৩০, ২০২৫, ০৫:৩৯ পিএম

ডিডির রাজ্যে কর্মচারীরা প্রজা! দুর্নীতিতে টইটম্বুর কিশোরগঞ্জ পরিবার পরিকল্পনা দপ্তর

ছবি বর্তমান বাংলাদেশ

দিনের পর দিন চলছে এক অদৃশ্য ভয়, চাপা আতঙ্ক, আর নীরবতার মধ্যে গুমরে মরছে কিশোরগঞ্জ জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। বাইরে থেকে সব স্বাভাবিক মনে হলেও ভেতরে যেন এক ভয়ঙ্কর নীরব দুনিয়া! আর সেই নীরবতার রাজা—উপপরিচালক (ডিডি) খন্দকার মাহবুবুর রহমান।

দপ্তরের ভেতরকার সূত্রগুলো বলছে, দীর্ঘদিনের দমন-পীড়ন আর অব্যাহত হয়রানিতে অতিষ্ঠ কর্মচারীরা অবশেষে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তবে নিজের নিরাপত্তার আশঙ্কায় কেউই পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি। কেউ নাম গোপন রেখে, কেউ মোবাইল মেসেজে, আবার কেউ নথিপত্রের কপি পাঠিয়ে গণমাধ্যমে তুলে ধরছেন ডিডির নানা অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের ছাপ।

অভিযোগকারীদের ভাষায়, খন্দকার মাহববুর রহমান যেন একজন সরকারি কর্মকর্তা নন—পুরো অফিসের অঘোষিত শাসক। কথায় কথায় কর্মচারীদের ‘চোর’  বলা, বকাঝকা, ভয় দেখানো, এসব যেন নিত্যদিনের বিষয়। তিনি নাকি প্রায়ই বলেন, চাকরি খেয়ে ফেলবো তোমার! এই এক বাক্যই নাকি এখন অফিসে আতঙ্কের প্রতীক।
একজন কর্মকর্তা বলেন, ওনার সামনে কথা বলার সাহস কারও নেই। সবাই জানে, একটু  এদিকোদিক হলেই বদলি বা চাকরি যাবে।

অভিযোগ আছে, দপ্তরের আসবাবপত্র ক্রয় থেকে শুরু করে বদলি বাণিজ্য পর্যন্ত, সবখানেই চলছে অর্থের খেলা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের আসবাবপত্র কেনায় ভুয়া বিল-ভাউচার দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ দিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা। এমনকি স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের একটি বিল ছাড়ের বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেনের অভিযোগও উঠেছে। এর পাশাপাশি, দপ্তরের মধ্যে তিনি নিজের অনুগত একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এদের কেউ অফিসে না এলেও, দেরিতে এলেও কোনো বাধা নেই। উল্টো তারা ডিডির বিশেষ আতিথেয়তা সামলায় বলে দাবি ভুক্তভোগীদের। অন্যদিকে, বাকিদের ওপর চলছে খামখেয়ালি বদলি ও হুমকি।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য এসেছে জেলা শহরের মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র থেকে। অভিযোগকারীদের দাবি, সেখানে রোগীদের কাছ থেকে সেবার নামে টাকা নেওয়া হয়, অথচ উপপরিচালক সব জেনেও চোখ বন্ধ করে রাখেন। বরং তিনি নিজে ওই কেন্দ্রের সরকারি বাসায় বসবাস করলেও মাসের পর মাস রাজস্ব কোষাগারে কোনো ভাড়া দেননি যা সরাসরি সরকারের রাজস্ব ক্ষতি।

অপরদিকে অভিযোগ উঠেছে, চুরির অপবাদে বদলি হওয়া তাড়াইল উপজেলার জাওয়ার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান কেন্দ্রের আয়া শিল্পী আক্তারকে গত ৬ এপ্রিল অর্থের বিনিময়ে কিশোরগঞ্জ সদরের মারিয়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান কেন্দ্রে সাময়িকভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন খন্দকার মাহবুবুর রহমান। পরক্ষনেই আদেশটি বাতিল করে শিল্পী আক্তারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে সংযুক্তি প্রদান করেন। শিল্পী আক্তারের চুরির বিষয়টিও প্রমাণিত হয়েছিল।

কর্মচারীরা বলছেন, একজন কর্মকর্তার অতি-ক্ষমতাবোধ পুরো দপ্তরকে অচল করে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ সেবা পেতে এসে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে, আর অফিসে কাজের চেয়ে ভয়ের সংস্কৃতিই এখন প্রধান।
একজন সিনিয়র কর্মকর্তা তিক্ত কণ্ঠে বলেন, এই অফিস এখন পরিবার পরিকল্পনার চেয়ে বেশি ভয়ের পরিকল্পনায় চলছে।

এমন একাধিক কর্মকর্তা তুলেছেন নানাধর্মী অভিযোগ, কেন এত অভিযোগ তার বিরুদ্ধে?  কিংবা খোদ নিজের ঘরের লোকইবা কেন ফাঁস করে দিচ্ছেন তার দুর্নীতির ফিরিস্তি?  নাকি ঘরের শত্রু বিভীষণ?  এর উত্তর খুঁজতে এবার মুখোমুখি সেই অঘোষিত রাজ্যের মহারাজ উপ-পরিচালক খন্দকার মাহবুবুর রহমানের ।

তবে সকল অভিযোগ অস্বীকার করে পরিবার পরিকল্পনার  উপ-পরিচালক( ভিভি) খন্দকার মাহবুবুর রহমানের কাছে আসবাবপত্র ক্রয়ের বিষয়ে জানতে চাইলো প্রকৃত সদুত্তর দিতে পারেনি বরং সব অভিযোগ মিথ্যা বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। অপরদিকে আসবাবপত্রের ক্রয় কমিটির সদস্য জানেই না আসবাবপত্র ক্রয় করা হয়েছে কিনা। বদলি বানিজ্য  নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ আমরা একজনকে তাড়াইল উপজেলা থেকে এখানে নিয়ে আসছি, এটার কারণ হচ্ছে সে অসুস্থ এবং তার স্বামী আমাকে এসে রিকুয়েস্ট করেছে  তাই  ওই শিল্পী আয়াকে বদলি করে এখানে আনা হয়েছে।

শেষ পর্যন্ত দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন যাতে ভয়ের দেয়াল ভেঙে পড়ে, আর সত্য বেরিয়ে আসে আলোর মুখে।

বর্তমান বাংলাদেশ

Link copied!