ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৫

কুলাউড়ায় শফিকুর রহমান মায়ের কোলে চড়ে কলেজে যায়, স্বপ্ন দেখে ডাক্তার হওয়ার

মৌলভীবাজার প্রতিনিধি

প্রকাশিত: অক্টোবর ৩০, ২০২৫, ১০:৪৯ এএম

কুলাউড়ায় শফিকুর রহমান মায়ের কোলে চড়ে কলেজে যায়, স্বপ্ন দেখে ডাক্তার হওয়ার

ছবি: বর্তমান বাংলাদেশ।

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া শফিকুর বর্তমানে এম.এ. গনী আদর্শ ডিগ্রি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। জন্ম থেকেই সে নিজে হাঁটতে পারে না। প্রতিদিন মা রশিয়া বেগমের কোলে চড়ে কলেজে যায় এবং ক্লাস শেষে মায়ের কোলে করেই বাড়ি ফিরে আসে।
জানা যায়,মায়ের কাঁধে ঝুলে থাকা একটি ব্যাগ, কোলে চড়ে যাওয়া এক কিশোর— দৃশ্যটি কুলাউড়ার ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের পশ্চিম গুড়াভুই গ্রামের মানুষের কাছে প্রতিদিনের চেনা। কিন্তু সেই কিশোরের নামটি আজ অনুপ্রেরণার প্রতীক— শফিকুর রহমান। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাকে থামাতে পারেনি, বরং আরও দৃঢ় করেছে তার স্বপ্নের পথে চলাকে।
বাবা রাজ্জাক মিয়া অসুস্থ থাকায় সংসারের ভার এখন মায়ের কাঁধে। দারিদ্র্য, শারীরিক সীমাবদ্ধতা আর প্রতিদিনের লড়াইয়ের মাঝেও শফিকুর তার শিক্ষা অর্জনের স্বপ্ন ছাড়েনি। প্রাথমিক ও এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়ে সে প্রমাণ দিয়েছে তার অদম্য মেধার। করোনার কারণে জেএসসি পরীক্ষা না হওয়ায় সেই সুযোগ না পেলেও শিক্ষকরা বলেন, “পরীক্ষা হলে সেখানেও সে সর্বোচ্চ ফল করত।”
২০২১ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় বিশেষ বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে সে। চেয়ারে বসে লিখতে না পারায় বিছানায় বসেই কষ্ট করে পড়াশোনা করে— কিন্তু তার মুখে কোনো অভিযোগ নেই, আছে শুধু স্বপ্ন আর দৃঢ়তা। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি শফিকুর এলাকার ছোট শিক্ষার্থীদের বিনা পারিশ্রমিকে পড়ায়। 
এম.এ. গনী আদর্শ ডিগ্রি কলেজের ছাত্রী জানায়,“শফিক স্যার শুধু বই না, জীবনের লড়াই শেখান। উনি বলেন, মানুষের মন ভাঙা না, মন জেতাই আসল শিক্ষা।” এই মানবিক আচরণ ও মেধা শফিকুরকে এলাকার সবার ভালোবাসার মানুষে পরিণত করেছে।
এলাকাবাসী বলেন,“শফিকুরের মতো মেধাবী ছেলেকে আমরা হারাতে চাই না। সরকার বা সমাজের কেউ যদি তার দায়িত্ব নেয়, তাহলে সে একদিন দেশের গর্ব হবে।”  তারা আরও জানান, শফিকুরের প্রতিদিনের কলেজে যাতায়াত ব্যয়ই এখন পরিবারের জন্য বড় বোঝা। রিকশাভাড়া ও বইপত্রের খরচ মেটাতে মা প্রায়ই বিপাকে পড়েন।
মা রশিয়া বেগম অশ্রুশিক্ত নয়নে বলেন,“প্রতিদিন ওকে কোলে নিয়ে যাওয়া খুব কষ্টের, কিন্তু আমি ক্লান্ত হই না। প্রতিদিন রিকশায় ওকে কলেজে নিতে হয়, ভাড়া জোগানো আমার পক্ষে কঠিন। তারপরেও ওর মুখের হাসিটা আমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। নিজের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি ওকে পড়াবো।” 
মায়ের এই অদম্য সংগ্রাম আর সন্তানের অধ্যবসায় আজ এক অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছে।
নিজের স্বপ্ন সম্পর্কে জানতে চাইলে শফিকুর রহমান বলেন,“আমি কখনও ভাবিনি আমি অন্যদের মতো নই। আমি বিশ্বাস করি, একদিন আমি ডাক্তার হবো— অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াবো। যদি সরকার বা সমাজ আমার পাশে থাকে, তাহলে হয়তো আমার স্বপ্ন আর মায়ের কষ্ট— দুটোই সফল হবে।” 
প্রতিবন্ধকতা ও দারিদ্র্য কোনো জীবনের শেষ কথা নয়— তা প্রমাণ করে দিয়েছে শফিকুর রহমান। অদম্য ইচ্ছাশক্তি, মায়ের ভালোবাসা ও সমাজের সহানুভূতি যদি একসঙ্গে কাজ করে, তাহলে এই মেধাবী ছাত্র একদিন দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কাতারে জায়গা করে নেবে। এখন দেখার পালা— সরকার ও সমাজ কি এগিয়ে আসবে শফিকুরের স্বপ্নকে বাস্তব করতে? যদি আসে, তবে শুধু শফিকুর নয়, আলো ছড়াবে তার মতো হাজারো স্বপ্নবাজ তরুণের জীবনেও।

বর্তমান বাংলাদেশ

Link copied!