★প্রকাশ্যে থাকলেও ধরা ছোয়ার বাইরে আ`লীগের রাঘব বোয়ালরা
★হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে মাদক
★নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের স্লোগান লেখনি কার্যক্রম থামেনি।
জামালপুর শহরে দিন দিন বেড়েই চলছে অপরাধ। আর এই অপরাধী শনাক্তে ও এদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে সদর থানা পুলিশ। এদিকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নামে কয়েকটি মামলা হলেও সেই মামলার আসামীদের গ্রেপ্তারে পুলিশের নেই তেমন কোনো তৎপরতা। চুনোপুটি কয়েকজন গ্রেপ্তার হলেও ধরা ছোয়ার বাইরে রয়েছে রাঘব বোয়ালরা। অন্যদিকে জামালপুরের রাণীগঞ্জ পতিতালয়ে মাদক ক্রয়-বিক্রয় কয়েকদিন যাবত কিছুটা নিয়ন্ত্রনে থাকলেও শহরের বিভিন্ন এলাকায় মাদক বিক্রি ও মাদক সেবনের প্রবনতা বেড়েছ। তবে এদের গ্রেপ্তারের সংখ্যা তুলানামূলক কম। এছাড়াও জামালপুর সদর থানায় বিভিন্ন চুরির অভিযোগ জমা না নিয়ে সাধারন ডায়েরী করার পরামর্শ দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ জমা দেয়ার পর সেটি এফআইআর করতে দীর্ঘ সময় নেয়া ও ভোগান্তির অভিযোগ করেছেন অনেকে।
চলতি বছরে জামালপুর থানায় চুরির ঘটনায় মামলা হয়েছে ৪০টির বেশি। আর সাধারন ডায়েরী হয়েছে এর তিন থেকে চার গুন বেশি। তবে বাস্তবিক চিত্রে সদর উপজেলাতে এমন অপরাধের সংখ্যা আরো কয়েক গুন বেশি আর এসব সমাধান বা নিষ্পত্তির সংখ্যা খুবই কম বলে দাবি করেছে জেলার সচেতন ব্যক্তিরা।
দিন দিন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় আশঙ্কা, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় দিন পার করছে শহরবাসী। এসব বিষয় নিয়ে জামালপুর বাসীর মাঝে চাপা ক্ষোভ থাকলেও পুলিশের ভয়ে কিছু বলতে সাহস পাননা অনেকে।
সম্প্রতি জামালপুর শহরতলীর আলীহারপুর থেকে রবিউল ইসলামের শখের মোটরসাইকেলটি চুরি করে নিয়ে যায় একটি অসাধু চক্র। উল্টো সেই মোটরসাইকেল ফিরিয়ে দিতে ফোন করে অর্থ দাবি করে তারা।
ভুক্তভোগী রবিউল ইসলাম বলেন-‘দিন দুপুরে রাস্তার পাশ থেকে আমার মোটরসাইকেলটি চুরি হয়ে যায়। উল্টো চুরে ফোন দিয়ে গাড়ি ফেরত দেয়ার জন্য অর্থ দাবি করছে। এমন হলো-আমাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি।’
এদিকে কিছুদিন আগে মঞ্জুরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির ইজিবাইক পুলিশ পরিচয়ে সুকৌশলে চুরি করে নিয়ে একটি চক্র। আয়ের একমাত্র সম্বল হারিয়ে এখন নি:স্ব হবার পথে জামালপুর শহরের বাসিন্দা ষাটোর্ধ এই ব্যক্তি।
ভুক্তভোগী মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন-‘একদিন রাতে আমার গাড়িতে পুলিশ পরিচয়ে কিছু লোক উঠেন। পরে তারা সুকৌশলে আমার ইজিবাইকটি চুরি করে নিয়ে যায়। এখন আমি নি:স্ব। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। অনেক খোজাখুজির পরেও আমি আমার গাড়িটি পাইনি। পুলিশও পাচ্ছে না।’
শুধু এই দুই ব্যক্তি নয়, স¤প্রতি জামালপুর শহরে চুরি বাড়ায় মোবাইল, মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক হারিয়েছে অনেকে। বেড়েছে বাসা-বাড়িতে চুরির ঘটনা, চুরি হচ্ছে কম্পিউটার, স্বর্ণালকার, নগদ অর্থসহ নানা ধরনের মূল্যবান জিনিসপত্র। এছাড়াও প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চুরির ঘটনাও ঘটছে। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন অনেকে।
ইঞ্জিনিয়ার রুবেল নামে একজন ভুক্তভোগী বলেন-‘২৪ আগস্ট আমি শ^শুরবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। এই সুযোগে চোর বানাকুড়া এলাকার আমার ভাড়া বাসার তালা ভেঙ্গে কম্পিউটার, মোবাইল, স্মার্ট ওয়াচ, নগদ অর্থ ও স্বর্ণলঙ্কার চুরি করে নিয়ে যায়। এই ঘটনায় পুলিশ এসে দেখে ছবি তুলে। কিন্তু দুঃখজনক এখন পর্যন্ত কোনো আসামী গ্রেপ্তার হয়নি। আমরা প্রতিনিয়ত শুনতে পারছি যে আশে পাশের বাসা-বাড়িতে চুরি হচ্ছে। এই পরিবেশে আমরা আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছি।’
শুধু চুরি নয়। বিভিন্ন মামলার ক্ষেত্রেও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে ভুক্তভোগীদের। থানায় মামলা এফআইআর-এর ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় নেয়া, আসামী গ্রেপ্তারে পুলিশের উদাসীনতার কারনে বিপাকে পড়তে হচ্ছে ভুক্তভোগীদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জামালপুর শহরতলীর হাটচন্দ্রা এলাকার একজন বলেন-‘ছোট একটি বিষয় নিয়ে আমার মাকে কয়েকজন পুরুষ মিলে মারধর করে। আমি এই ঘটনায় জামালপুর সদর থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করি। কিন্তু বার বার ধরনা দেয়ার পরেও থানার পুলিশ ও ওসি সাহেব অভিযোগটি বেশ কয়েকদিন পরে এফআইআর করেন। আর আসামীদের গ্রেপ্তারে পুলিশের উদাসীন ভূমিকা আমরা লক্ষ্য করেছি। এতে করে আসামীরা সুযোগ পেয়ে যায় এবং আদালত থেকে জামিন নিয়ে আসে।’
এদিকে জামালপুর শহরে এখন হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে মাদক। বেড়েই চলেছে মাদক বিক্রি ও সেবনের প্রবনতা। পুরো শহরের বিভিন্ন স্থানে মাদক বিক্রি হলেও সবচেয়ে বেশি মাদক বিক্রি হয় মুসলিমাবাদ, বাগেরহাটা ও গেইটপাড় এলাকায়। মাদক ব্যবসায়ীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ এই অঞ্চলের লোকজন। সবচেয়ে বেশি বেচাকেনা হয় মদ, গাজা, ইয়াবা ও হেরোইন।
শহরের চামড়াগুদাম এলাকার বাসিন্দা সাকিব হাসান বলেন-‘মুসলিমাবাদের মাদক ব্যবসায়ীদের জন্য এলাকার তরুন ও যুবক ব্যক্তিরা ধ্বংস হবার পথে। সন্ধ্যা হলেই এই এলাকার অলি-গলিতে চলে মাদক সেবীদের আড্ডা। পুলিশ মাঝে মধ্যে দুই একজনকে গ্রেপ্তার করলেও অধিকাংশই থাকে ধরা ছোয়ার বাইরে। এভাবে চলছে চোর-পুলিশ খেলা। মাঝখান থেকে নষ্ট হচ্ছে যুবসমাজ। ’
জেলখানার দেয়াল, আদালতের দেয়ালসহ শহরের অত্যন্ত ১৫টি জায়গায় নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের স্লোগান লেখা থাকলেও, পুলিশ কাউকেই শনাক্ত করতে না পারায় ক্ষোভ জুলাইয়ে রাজপথে থাকা অংশীজনদের।
জেলার সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন- অপরাধ দমনে সদর থানার নিষ্ক্রিয়তা, অযোগ্যতাসহ নানা কারনে বেড়েছে চুরির ঘটনা। এছাড়াও সমাধান না পাওয়ায় অনেকে নিচ্ছেন না আইনী পদক্ষেপ।
জামালপুরের বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন -‘২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর কয়েক দিন পুলিশ না থাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবনতি হয়েছিলো। বর্তমানে জামালপুর শহরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক তেমন না হলেও খুব একটি ভালো নয়। এর কারন হিসেবে আমি যেটি মনে করি- জামালপুর সদর পরিচালনার ক্ষেত্রে পুলিশের যে চেয়ারে যেমন দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তা থাকা প্রয়োজন, সেই চেয়ারে তেমন কর্মকর্তা নেই। তারা চাইলেও অপরাধ দমন করতে পারছেন না। কারন তারা সেভাবে দক্ষ ও যোগ্য নয়।’
জাহাঙ্গীর সেলিম আরো বলেন-‘জেলার সবগুলো থানার মধ্যে জামালপুর থানায় পুলিশের স্টাফ সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও সব থানার চেয়ে এই থানায় গাড়িসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সবচেয়ে বেশি। তবুও এই থানার আওতাধীন এলাকায় অপরাধের সংখ্যা বেশি। আর এসব অপরাধী শনাক্ত ও অপরাধ দমনে পুলিশের উদ্যোগ ও ইচ্ছা থাকলেও এর কার্যকারিতা খুবই কম।’
জামালপুরের সাংবাদিক সাইমুম সাব্বির শোভন বলেন-‘জামালপুরে কোনো চুরি বা ছিনতাই-এর ঘটনা ঘটলে আমরা লক্ষ্য করি যে- ভুক্তভোগীরা সদর থানায় অভিযোগ করতে তেমন আগ্রহী থাকে না। এর দুইটি কারন রয়েছে- ভুক্তভোগীরা জানেন যে, অভিযোগ করে বিষয়টির কোনো লাভ বা সমাধান-সুরাহা হবে না। আর অভিযোগ করতে গেলে উল্টো তাদের ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হবে। জামালপুর সদর থানার এমন ভাবমূর্তির কারনে অনেকে অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকেন।’
সাংবাদিক শোভন আরো বলেন-‘এক বছরের মধ্যে আমার দুইটি মোটরসাইকেল চুরি হয়েছে। সবশেষ মোটরসাইকেলটি দুই সপ্তাহ আগে চুরি হয়েছে। এসব ঘটনায় আমি একটি সাধারন ডায়েরী করেছি এবং একটি অভিযোগ দিয়েছি। আজ পর্যন্ত উদ্ধার তো দূরের কথা ঘটনার কোনো ক্লু পাইনি পুলিশ।’
জামালপুর জেলা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা যায়-জামালপুর থানার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু ফয়সল মোঃ আতিক দীর্ঘদিন ট্যুরিস্ট পুলিশে কর্মরত ছিলেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর তিনি জামালপুর সদর থানায় যোগদান করেন। তাই তার কাজ খুবই ধীরগতির ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে দেখা যায় তার অবহেলা। এছাড়াও ময়মনসিংহ বিভাগের পুলিশের উর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তার বাড়ি এবং ওসি আবু ফয়সল মোঃ আতিকের বাড়ি একই অঞ্চলে। এই জন্য ওসি আতিক সরাসরি ময়মনসিংহের সেই কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ রাখেন এবং জামালপুর জেলা পুলিশের কর্মকর্তাদের দাপ্তরিক চাপ তিনি গ্রাহ্য করেন না। তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলেও ওসি আবু ফয়সল মোঃ আতিক নিজ গতিতেই কাজ চালিয়ে যান। এসব কারনে তাকে কয়েক বার বদলির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় জেলা পুলিশ। তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে জামালপুর থানার উপর ভরসা না করে জেলা গোয়েন্দা শাখা(১)-কে কাজে লাগাচ্ছে জেলা পুলিশ।
জামালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু ফয়সল মোঃ আতিক বলেন- ‘এর আগে মোটরসাইকেল চুরির ঘটনায় মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া গ্রেফতারও হয়েছে। থানায় মামলা করতে কোনো হয়রানি নেই। আমরা চেষ্টা করছি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে।
তবে জামালপুরের পুলিশ সুপার সৈয়দ রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান-এসব অপরাধ দমনে ডিএসবি ও ডিবিকে কার্যকরী ভূমিকা নেয়ার জন্য বলা হয়েছে। যারা এসব চুরির সাথে লিপ্ত, তাদেরকে আমরা আইনের আওতায় আনবো। এছাড়াও আমরা রাতের পাহারাদারদের সাথে যোগাযোগ করেছি। যাতে তারা পাহারাগুলো আাের জোড়দার করে ও সচেতন থাকে। এছাড়াও নিজস্ব সম্পত্তি হেফাজতে রাখতে সকলকে সচেতন থাকার পরামর্শ দেন সৈয়দ রফিকুল ইসলাম।
আপনার মতামত লিখুন :