# বছরে ৫০ কোটি টাকার গহনা বিক্রি,
# মাসে ২০ লাখ জোড়া গহনা তৈরী
# কারিগরদের বেশির ভাগ নারী
দেশের সীমান্তবর্তী জেলা ঝিনাইদহ। এ জেলার মহেশপুর উপজেলা জুড়ে ভারত সীমান্ত। এই সীমান্তবর্তী উপজেলা দেশের অর্থনীতিতে নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে ইমিটেশন গোল্ড জুয়েলারী পণ্য উৎপাদনে। ভারতের একচেটিয়া বাজার টপকে এক সময়ের শতভাগ আমদানী নির্ভরতা কাটিয়ে বর্তমানে এই শিল্পে দেশে যে ২০ শতাংশ ইমিটেশন গোল্ড জুয়েলারী তৈরী হচ্ছে তার অর্ধেকের যোগান আসছে ঝিনাইদহ থেকে।
এই ব্যাসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে- বছরে ঝিনাইদহ থেকে উৎপাদিত হচ্ছে কমপক্ষে ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকার গহনা। প্রতি মাসে এখানে ২০ লাখ জোড়া গহনা তৈরী করছে এ শিল্পের সাথে জড়িত কারিগররা। এখানকার ৩ হাজারের বেশী পরিবারে কারিগরের সংখ্যা ৬ হাজারের বেশী যার অর্ধেকই নারী। কর্মসংস্থানের সুযোগ হওয়ায় ভারত সীমান্তবর্তী জেলাটিতে বদলে গেছে গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্রও।
যা তৈরি হয় এখানে
বড় সাইজের চিক, কন্ঠচিক, সীতাহার, লকেট, চুড়ি, আংটি, মানতাশা, কানের দুল,ঝাপটা,ঝুমকা, চেইন, বেসলেট, আংটি সহ উন্নত ডিজাইনের গহনা তৈরী হচ্ছে। বিশেষ করে এখানকার কানের দুল সারাদেশে বিখ্যাত।
শিল্পের স্বীকৃতিসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি, কারিগরি সহায়তা আর উন্নত প্রশিক্ষণ পেলে নিজস্ব ডিজাইনের নিপুন কারুকার্য খচিত এসব গহনা দেশীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাইরের বাজারে রপ্তানী সম্ভব।

যেভাবে কাজ করে কারিগররা
ছোট ছোট দলবেঁধে বসে ছাঁচে আর ডিজাইনে কেউ কেউ গলাচ্ছেন নানা ধাতব পদার্থ, কারো মনোযোগ নকশাতে, কারো বা হাতে চলছে গয়নার চূড়ান্ত ডিজাইন। কেউ আবার পুঁতি সাজাচ্ছে কোথাও বা চলছে স্বর্ণের সোনালি রঙের কাজ। শিল্পের স্বীকৃতি সহ আধুনিক যন্ত্রপাতি, কারিগরি সহায়তা আর উন্নত প্রশিক্ষণ পেলে নিজস্ব ডিজাইনের নিপুন কারুকার্য খচিত এসব গহনা দেশীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাইরের বাজারে রপ্তানী সম্ভব। এমনটি আশা করছে ইমিটেশন গহনার মালিক, উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী আর কারিগররা।
পড়াশোনার ফাঁকে কাজ করে অর্থ উপার্জন করেন শিক্ষার্থীরা
অসংখ্য বেকার তরুন, শিক্ষিত যুবক আর স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে ইমিটেশন বা সিটিগোল্ডের কারখানায় কাজ করে বাড়তি উপার্জন করছে। কেউ সংসারে সহায়তা করছে, কেউ পুরো সংসার চালাচ্ছে এমন কাজের সাথে যুক্ত হয়ে। কেউ হয়েছেন দক্ষ কারিগর। মহেশপুর উপজেলার আজমপুর, মান্দারবাড়িয়া ও নাটিমা এই ৩ ইউনিয়নের ১১টি গ্রাম ও পৌরসভা জুড়ে ইমিটেশন পল্লীর বিস্তৃতি।

সোনিয়া, ময়না ও রেশমাদের স্বাবলম্বী হওয়ার গল্প
ইমিটেশন গোল্ড জুয়েলারীর একজন দক্ষ কারিগর গৃহবধু সোনিয়া খাতুন। বাড়ি বসেই গহনা তৈরীর কাজ করে মাসে ৮ হাজার টাকার বেশী আয় করেন, নিজে আয় করেন ফলে অর্থের প্রয়োজন হলে স্বামী-শ্বশুরালয়ে হাত পাতা বা চেয়ে থাকতে হয় না। তবে তার পেছনের গল্পটি খুব একটা সহজ ছিল না। মহেশপুরের নওদাগ্রামে বিয়ের পর স্বামী মাসুম পারভেজের সংসারে এসে দেখেন স্বামী-শ্বশুরালয়ের অনেকেই গহনা তৈরীর কাজ করছে। তবে তাকে এসব কাজে উৎসাহ না দিয়ে বলা হতো ‘তুমি পারবে না, পারবে না’, পারবো না কেন এমন জেদ থেকেই সোনিয়া এখন স্বাবলম্বী আর দক্ষ কারিগর।
একই গ্রামের রেশমা বেগম তার বাড়িতে এমন গহনার কাজ করছেন গত ৭বছর ধরে। আগে সংসারের পাশাপাশি অন্যান্য কাজ করতেন তবে গহনা তৈরীর কাজ শেখার পর এখন এটিই তার নিজস্ব ব্যবসা হিসাবে দাঁড় করিয়েছেন। তার প্রতিদিনের আয় ৪শ টাকা। একটি বে-সরকারী সংগঠন থেকে পেয়েছেন নানা প্রশিক্ষণ আর সহায়তা।
আর গত ১৫ বছর ধরে স্বামী-সন্তান সহ ময়না খাতুনের পুরো পরিবার গহনা তৈরী ও কেনা-বেচার সাথে যুক্ত। অনেকগুলো কারিগরও তাদের বাড়িতে গহনা তৈরীর পেশাতে যুক্ত।
এমন গল্প শুধু সোনিয়া, রেশমা বা ময়না খাতুনের নয় মহেশপুরের ৪টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার হাজার হাজার নারীর স্বাবলম্বী হওয়ার গল্প। প্রশিক্ষন আর সহায়ক কর্মপরিবেশে কেউ হয়েছেন দক্ষ কারীগর, কেউ বা উদ্যোমী অদম্য উদ্যোক্তা আবার কেউ বা ঝানু ব্যবসায়ী, এ যেন রুপকথার এক ইমিটেশন পল্লীর গল্প।

যা বলছেন মালিকরা
মহেশপুরের আরোহী সিটি গোল্ড হাউজের মালিক সামাদ হোসেন জানান, দেশের সর্বত্র এখন ইমিটেশনের যে গহনা পাওয়া যায় তার বেশিরভাগই ঢাকার সাভারের ভাকুর্তা ও বগুড়ার কারিগরদের হাতে তৈরী হলেও ঝিনাইদহের মহেশপুরের ইমিটেশন পল্লী দাঁড়িয়ে গেছে শক্ত অবস্থানে, বিশেষ করে দুলের জন্য বিখ্যাত দেশজুড়ে। ঢাকা, রাজশাহী, নাটোর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, জামলপুর, সিলেট, হবিগঞ্জ সহ সারা দেশে যায় এখানকার ইমিটেশন গোল্ড জুয়েলারী।
মহেশপুরের যশোর কালার হাউজের কারখানা মালিক মেজবাহ উদ্দিন জানান, অটোমেশন বা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়ায় ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে অনেক সময় ব্যয় করে পর্যায়ক্রমে বাজারে নিজেদের তৈরী দেশীয় ইমিটেশনের গহনা ছাড়ার পর ভারতীয় ব্যবসায়ীরা অনেকটাই কোনঠাসা । কারণ ভারতের একটি কানের দুল দেশে বিক্রি হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। সেখানে নিজেদের তৈরী একটি কানের দুল, গহনা মাত্র ২০ থেকে ২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে ।
ইমরান সিটি গোল্ডের কারখানা মালিক ও অন্যতম বড় ব্যবসায়ী জানান, দেশের চট্টগ্রাম জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প থেকে আসছে তামা,পিতল-ব্রোঞ্জ সহ ইমিটেশন জুয়েলারী তৈরীর কাঁচামালও। ফলে এই শিল্পের বাজারে আশার আলো দেখছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা।
আমদানী নির্ভর এই ইমিটেশন গোল্ড জুয়েলারীর প্রতিযোগিতামূলক বাজারে প্রশিক্ষণ না থাকায় ইমিটেশনের ছোট গহনা বা মালামাল তৈরি করে টিকতে পারছিল না এখানকার কারিগররা,ছিল আর্থিক সংকটও। তবে গত ১যুগেরও বেশী সময় ধরে বিশ্ব ব্যাংকের আর্থিক সহায়তা পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশ(পিকেএসএফ) ও আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ইফাদ) এসইপি প্রকল্পের সহযোগীতায় স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ, ঋণ সহায়তাসহ সার্বিক সহযোগিতায় এ সেক্টর হয়েছে অনেকটাই পরিণত। বেড়েছে গুণগতমান, সম্প্রসারিত হয়েছে দেশের বাজারও। যশোরের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা শিশু নিলয় ফাউন্ডেশন প্রকল্পগুলি বাস্তবায়ন করছে।

যা বলছে বে-সরকারী এই সংগঠন
বে-সরকারী এই সংগঠনটির(শিশু নিলয় ফাউন্ডেশন) ইমিটেশন গোল্ড জুয়েলারী প্রজেক্টের ম্যানেজার ইমদাদুল ইসলাম জানান, আগে এসব গহনার ১’শ ভাগই ছিল আমদানী নির্ভর, চীন আর ভারতের দখলে ছিল বাজার। বর্তমানে সে পরিস্থিতি বদলে ২০শতাংশ বাজার দখল করতে পেরেছে দেশীয় কারিগর ও কারখানাগুলো। এর ১০ শতাংশ তৈরী হচ্ছে সাভারের ভাকুর্তা ও বগুড়া জেলাতে । বাকী ১০ শতাংশ ইমিটেশন গোল্ড জুয়েলারী তৈরী হচ্ছে ঝিনাইদহের মহেশপুরে। বছরে ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকার ইমিটেশন জুয়েলারী পণ্য উৎপাদন সহ হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে ঝিনাইদহের মহেশপুরের ইমিটেশন জুয়েলারী পল্লী থেকে।
মহেশপুরের ইমিটেশন গোল্ড জুয়েলারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন ব্যবসায়ী নেতা সাইফুল ইসলাম। তিনি জানান, দেশে ইমিটেশন জুয়েলারীর হাজার হাজার কোটি টাকার একচেটিয়া বাজার এখনো ভারত-চীনের দখলে রয়েছে। তবে ভারতের বাজার কমলেও চীনের বাজার এখনো জমজমাট। তিনি বলেন দেশীয় বাজারে নিজেদের গহনার চাহিদা বাড়ছে তবে ২৫ থেকে ৩০ পার্সেন্ট বাজারও এখনো দখল করা সম্ভব হয়নি। প্রতিযোগীতামূলক বাজারে টিকতে শিল্পের স্বীকৃতি, শিল্পের সুযোগ-সুবিধা, বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ, অটোমেশন সহ আধুনিক যত্রপাতি কিনতে সরকারী সহায়তা ।
বিসিক ঝিনাইদহ জেলা কার্যালয়ের উপ-ব্যবস্থাপক সেলিনা রহমান জানান, দেশের অর্থনীতির চিত্র বদলে দিতে বড় ধরনের ভ’মিকা রাখছে মহেশপুরের ইমিটেশন পল্লী । তিনি জানান, সেখানকার কারিগররা ছোট ছোট দলবেঁধে প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়ে, ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে নামমাত্র সুদে ঋণ নিতে পারে যা তাদেও আয় ও উৎপাদন কার্যক্রম কে আরো সহজ করবে।

এই শিল্পের সাথে জড়িতদের ব্যাংকলোন, প্রশিক্ষণ সহ সর্বাত্মক সহযোগীতার আশ্বাস দিয়েছেন ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক এসএম রফিকুল ইসলাম । এমন কি মন্ত্রনালয়ে যোগাযোগ করে কর্মসংস্থান সহ ইমিটেশন জুয়েলারী গহনা বিদেশে রপ্তানি ও বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের চেষ্টা করা হবে বলে জানান প্রশাসনের এই কর্মকর্তা।
প্রসঙ্গত, ২০০৪ সালের দিকে দেশের সীমান্তবর্তী ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলায় একেবারে নিজস্ব উদ্যোগে গড়ে উঠে সিটি গোল্ড নামে ইমিটেশন জুয়েলারী কারখানা। এখন হাজার হাজার মানুষ ব্যক্তি উদ্যোগে ঘরে বসেই এই ইমিটেশন গহনা তৈরি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে। বদলে গেছে সীমান্তবর্তী মানুষের জীবনযাত্রাও ।
আপনার মতামত লিখুন :