ঢাকা সোমবার, ০৭ জুলাই, ২০২৫

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর ডিও দুদকের তদন্তাধীন প্রকল্পে অর্থছাড়ের সুপারিশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: জুলাই ৬, ২০২৫, ১০:৩১ এএম

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর ডিও  দুদকের তদন্তাধীন প্রকল্পে অর্থছাড়ের সুপারিশ

বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানির (বিটিসিএল) আলোচিত ফাইভজি রেডিনেস প্রকল্পটি এগিয়ে নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে সুপারিশ করা হয়েছে। প্রায় ৩২৬ কোটি টাকার এ প্রকল্পে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এবং সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এ প্রকল্পের দুর্নীতির বিষয়টি নতুন করে সামনে আসে। এখন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিষয়টি তদন্ত করছে। 

বিটিসিএল ফাইভজি রেডিনেস প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা কমিশনে অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মাধ্যমে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা (ফিজিবিলিটি স্টাডি) করা হয়। প্রকল্প প্রস্তাবও (ডিপিপি) প্রণয়ন করা হয় বুয়েটের সমীক্ষার আলোকে। পরে চীনের হুয়াওয়ে ও জেডটিই এবং নকিয়া নামে তিনটি প্রতিষ্ঠান দরপ্রস্তাব জমা দেয়। তবে ঠিকাদার নিয়োগ নিয়ে তৎকালীন টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী ও সচিবের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। একপর্যায়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অভ্যন্তরীণ বৈঠকে প্রকল্পের দরপত্র বাতিল করে নতুন দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত দেন মোস্তাফা জব্বার। সে সময়ের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান মন্ত্রীর সিদ্ধান্ত না মেনে এক দিনের নোটিশে বিটিসিএলের বোর্ড সভা ডাকেন। আর্থিক মূল্যায়ন সম্পন্ন করে চীনা একটি প্রতিষ্ঠানকে সেই দিনই কার্যাদেশ দেন। 

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে ফাইভজি রেডিনেস প্রকল্পের অনিয়ম তদন্তে একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রতিবেদন জমা দেয়। 

প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সাবেক সচিবের (পদাধিকারবলে বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান) বিরুদ্ধে অনিয়মের সরাসারি প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং তথ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণে অনিয়মের মাত্রা গুরুতর এবং নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বুয়েটের বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদন উপেক্ষা করে ২৬ টেরাবাইট সক্ষমতার প্রকল্পে সক্ষমতা ১২৬ টেরাবাইট উল্লেখ করে প্রকল্পের খরচ অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া বিটিসিএলের বোর্ড সভা ডাকাসহ দরপত্র মূল্যায়ন থেকে কার্যাদেশ দেওয়া পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে অনিময় হয়েছে, পাশাপাশি কোম্পানি বিধিও লঙ্ঘন করা হয়েছে। একই সঙ্গে তদন্তে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সাবেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রকল্পের দরপত্র মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় অনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং বিটিসিএলের একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ার কথাও বলা হয়। দুটি চীনা কোম্পানির বিরুদ্ধে দরপত্র প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার সত্যতাও মেলে। তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়ার পরও দুর্নীতি-সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। 

বরং গত ২১ এপ্রিল ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে দুদক মহাপরিচালক বরাবর চিঠি দিয়ে তদন্তকালীন সময়ে ফাইভজি রেডিনেস প্রকল্পের যন্ত্রপাতি কেনার  চূড়ান্ত বিল পরিশোধের জন্য সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কারখানা পরিদর্শনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। এর জবাবে গত ১৮ জুন দুদক থেকে জানানো হয়, দুদকের অনুসন্ধানী দল এরই মধ্যে এ প্রকল্পে অনিয়ম দুর্নীতির প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে। এ ছাড়া খোদ বিটিসিএলের আইনজীবী মতামত দিয়েছেন, তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে চিহ্নিতদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। এ অবস্থায় তদন্ত চলাকালে এ প্রকল্পের ক্রয় প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া এবং অর্থ ব্যয় করা আইনসিদ্ধ হবে না বলে জানায় দুদক। 

দুর্নীতি দমন কমিশনের এই জবাবের পর প্রকল্পের অর্থছাড়ে অনুমতির জন্য গত ২২ জুন দুদক বরাবর ডিও লেটার দেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তিনি ওই ডিও লেটারে লেখেন, ‘দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ফাইভজি প্রযুক্তিতে বিটিসিএলের পিছিয়ে পড়া রোধ, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের হার নিশ্চিত করা এবং এ প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরেকটি প্রকল্পের যন্ত্রপাতি চালুর জন্য ফাইভজি রেডিনেস প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান রাখা প্রয়োজন। এ বিষয়ে আপনার মনোযোগ ও সহায়তা কামনা করছি।’ চিঠিতে তিনি দাবি করেন, প্রকল্পের যন্ত্রপাতি কেনায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিল দেওয়ার আগে বিশেষজ্ঞ কমিটি  যন্ত্রপাতিগুলো ফাইভজির উপযোগী কিনা, পরবর্তী ন্যূনতম ১২ বছরের জন্য সেবা দেবে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। 

এ ব্যাপারে বিটিসিএলের সাবেক এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ফাইভজি চালু হলে দেশে আগামী এক যুগের মধ্যে ডেটার ব্যবহার সর্বোচ্চ ২৬ টেরাবাইটে দাঁড়াতে পারে বলে বুয়েটের সমীক্ষায় উঠে এসেছে। আর বর্তমানে দ্রুত প্রযুক্তির বিবর্তন হচ্ছে। এ কারণে পাঁচ বছরের বেশি একটি প্রযুক্তির কার্যকারিতা বিবেচনা করেই বর্তমানে নতুন প্রযুক্তি স্থাপন ও প্রযুক্তি হালনাগাদ-সংক্রান্ত প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু বিটিসিএলের ফাইভজি রেডিনেস প্রকল্পের ক্ষেত্রে ১২৬ টেরাবাইট সক্ষমতা এবং ১২ বছরের রক্ষণাবেক্ষণ সময় ধরা হয়েছে, যা  অযৌক্তিক ও অবাস্তব। শুধু প্রকল্পের ব্যয় ১০ গুণ বাড়ানোর জন্যই অতিরিক্ত সক্ষমতা এবং ১২ বছর রক্ষণাবেক্ষণ সময় ধরা হয়েছে। 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রকল্প এগিয়ে নেওয়ার যৌক্তিকতা নির্ধারণে যথাযথভাবে সবকিছু বিশ্লেষণ করা হয়েছে কিনা– এটাই প্রশ্ন। যদি না হয়ে থাকে, তা হবে প্রকারান্তরে দুর্নীতির সুরক্ষার নামান্তর। এলসির অর্থ লোকসানের যুক্তিতে প্রকল্প এগিয়ে নিলে রাষ্ট্রের আরও বড় আর্থিক ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তকে ছাড় দেওয়া বা তদন্ত প্রক্রিয়া প্রভাবিত করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সিদ্ধান্ত যাই হোক, কোনোভাবে তা যেন দুর্নীতির তদন্তকে প্রভাবিত না করে। 

দুদকের পরিচালক (মানি লন্ডারিং) মোরশেদ আলম এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়েও সাবেক টেলিযোগাযোগ সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

এ ব্যাপারে সাবেক মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, আমার দিক থেকে নিয়ম মেনেই কাজ করা হয়েছে। কাগজপত্রেই তার প্রমাণ রয়েছে। কেউ চাইলে তা যাচাই করে দেখতে পারে। 

জানতে চাইলে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বৃহস্পতিবার রাতে বলেন, ডিও লেটারেই বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। বেসরকারি কোম্পানিগুলো একই যন্ত্রপাতি দিয়ে ইতোমধ্যে উচ্চ ক্ষমতার নেটওয়ার্ক করছে, তাই তারা চায় না সরকারি প্রতিষ্ঠান এ সক্ষমতা অর্জন করুক। তারা অবৈধভাবে নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করে বিটিসিএলের ব্যবসার ক্ষতি করতে চায়। এ জন্য অবৈধভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। এ ছাড়া যন্ত্রপাতি কেনায় সরকারের ফেরত অযোগ্য এলসি হয়ে গেছে, ২৯০ কোটি টাকা অর্থ ফেরত আসবে না। ডলারের দাম ৩৫ শতাংশ বাড়ায় একই কাজ করতে এখন অনেক টাকা খরচ হবে।

সূত্র:সমকাল

বর্তমান বাংলাদেশ

Link copied!