ঢাকা মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

৩০ তম কারাম উৎসবে মাতোয়ারা তারা,,,

বিকাশ চন্দ্র প্রামানিক, নওগাঁ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৫, ০৯:২৭ পিএম

৩০ তম কারাম উৎসবে মাতোয়ারা তারা,,,

ছবি: বর্তমান বাংলাদেশ।

পায়ে আলতা, খোপায় বাহারি ফুল, শাড়ি আর ঢোল মাদলের তালে তালে রিমঝিম নাচ। সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর গানে মুখরিত চারপাশ। ঢোল আর মাদলের তালে নাচে-গানে মাতোয়ারা হয়ে নওগাঁর মহাদেবপুরে উদযাপন করা হলো ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠিরদের ৩০তম ঐতিহ্যবাহী কারাম উৎসব।

ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠির সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব কারাম পূজা। বংশপরমপরায় ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠিরা পূজা-অর্চনা আর নাচ-গানের মধ্য দিয়ে যুগ যুগ ধরে প্রতি বছর উত্তরের সমতল ভূমির নওগাঁর ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠিরা এই কারাম উৎসব পালন করে আসছে।

সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) বিকেলে উপজেলার নাটশাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ নওগাঁ জেলা কমিটির আয়োজনে ঐতিহ্যবাহী এ উৎসব পালিত হয়। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইনিশিয়েটিভ সোসাল চেঞ্জ (আইএসসি) এই আয়োজনে আর্থিক সহযোগিতা করে।  

দুই দিনব্যাপী উৎসবের প্রথম দিন গত রোববার রাতে উপজেলার নাটশাল, বকাপুর, জৈন্তাপুর, ঋষিপাড়াসহ আশপাশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী গ্রামের নারী-পুরুষ বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করেন। রোববার দিনভর উপোস ছিলেন তারা। সন্ধ্যার আগে কারাম বা খিল কদমের ডাল কেটে এনে পূজার বেদিতে বসানোর কাজটি করেন যুবকেরা। আর সন্ধ্যার পর কারামগাছের ডাল বেদিতে বসানোর পর শুরু হয় পূজা। এরপর রাতভর মূল আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নেন নারীরা। তারা দিয়াবাতি, জাওয়া ডালি (অঙ্কুরোদগম শস্যবীজের ডালি), লাল মোরগ, ফলমূলের ডালা বা থালা সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে পূজার বেদিতে উৎসর্গ করেন। সেখানে পূজা পর্ব পরিচালনা করেন পুরোহিত।

রাত একটু গভীর হলে শিশু, কিশোর-কিশোরীসহ বিভিন্ন বয়সী নর-নারী গ্রামের পূজাস্থানে জড়ো হন। সেখানে পুরোহিত নতুন প্রজন্মের কাছে কিচ্ছা আকারে কার্মা ও ধার্মা- দুই ভাইয়ের কাহিনি তুলে ধরেন। কিচ্ছা বলা শেষ হলে উপোস থাকা নারীরা পরস্পরকে খাবারের আমন্ত্রণ জানিয়ে উপোস ভাঙেন। পরে বেদিতে পুঁতে রাখা কারাম ডালের চারপাশ ঘুরে ঘুরে ঢাকঢোল ও মাদলের বাজনার তালে তালে নৃত্য পরিবেশন করেন নারীরা। রাতের পূজা পর্ব শেষে সোমবার সকালে সবাই মিলে বিভিন্ন আচার শেষে গীত গাইতে গাইতে কারাম ডালকে গ্রামের পুকুরে বিসর্জন দেন।

পূজা পর্ব শেষে এদিন বিকেলে নাটশাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে সাংস্কৃতিক মিলনমেলা ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এ মিলনমেলায় নওগাঁর মহাদেবপুর, পত্নীতলা, নিয়ামতপুর উপজেলা ছাড়াও জেলার অন্যান্য উপজেলা এবং পাশবর্তী জয়পুরহাট ও নাটোর জেলা থেকে মোট ২৫ টি বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক দলগুলো অংশ নেয়। তারা নিজ নিজ জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্য তুলে ধরে ঢাকঢোল, মাদল ও করতালের (ঝুমকি) তালে তালে নাচ ও গান পরিবেশন করে। এতে শিশু, কিশোর-কিশোরীসহ নানা বয়সী মানুষ দলবদ্ধ ছন্দময় নাচের মাধ্যমে তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতির গানের সাথে নাচ পরিবেশন করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক দলগুলো।

এ সময় পুরো এলাকা ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠিসহ সকল সম্প্রদায় মানুষের হয়ে উঠে মিলন মেলা। এলাকার কারাম উৎসব উপলক্ষে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠিরা এসময় মূখরিত হয়ে থাকে।

এটি মূলত সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষের বৃক্ষ পূজার উৎসব। কারাম (খিল কদম) ডালপূজাকে কেন্দ্র করে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয় বলে একে কারাম উৎসব বলা হয়। ধান রোপনের পর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষের অফুরন্ত অবসর। বহুকাল ধরে ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে।

সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রধান উৎসব কারাম। ভাদ্র মাসের পূর্ণিমায় (শুক্লা একাদশী তিথি) এ উৎসবের আয়োজন করে তাঁরা। ক্ষুদ্র জাতিসত্তা অধ্যুষিত গ্রামে গ্রামে কারাম বৃক্ষের ডালপূজাকে কেন্দ্র করে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। তাদের বিশ্বাস, এটি অভাবমুক্তি ও সৌভাগ্য লাভের উৎসব। ধর্মীয় বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার কাছে মনের কামনা-বাসনা পূরণের লক্ষ্যে প্রার্থনা করে থাকে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ। এ ছাড়া নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯৯৬ সাল থেকে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ এ পূজাকে ঘিরে নওগাঁসহ সমতলের বিভিন্ন অঞ্চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আদিবাসী সম্মেলনের আয়োজন করে আসছে।

জেলার পত্নীতলা থেকে আসা অঞ্জলী খানকো বলেন- কারাম আমাদের জাতীয় উৎসব এবং বংশ পরমপরায় পালন করে আসছি। এ পুজার মাধ্যমে সংসারের উন্নতি, স্বামী-সন্তান ও পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকতে পারবো ঈশ্বরের কাছে এই চাওয়া।

নবম শ্রেনীর শিক্ষার্থী লাকী তিরকি জানায়- ঈশ্বরের কাছে চাওয়া পড়াশুনা ভাল করাসহ যেন জীবনে উন্নতি করতে পারি। এছাড়া বাবা-মা‍‍`র সেবা করা সহ দেশবাসীর সেবা করতে পারি। এ উৎসবে দল বেঁধে নাচতে পেরে অনেক খুশি।

জেলা জাতীয় আদিবাসী পরিষদ সভাপতি আমিন কুজুর বলেন- ১৯৯৬ সাল থেকে জাতীয় ভাবে এ উৎসব পালন করা হচ্ছে। দলবদ্ধ ছন্দময় নাচের মাধ্যমে তাদের নিজেদের ভাষা সাংস্কৃতি তুলে ধরে। আমাদের ৯টি দাবী আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও পৃথক ভূম কমিশন গঠন করার দাবী জানায়।

এদিন বেলা তিনটায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক মিলনমেলার উদ্বোধন করেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি গণেশ মার্ডি। প্রধান বক্তা ছিলেন- কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিমল চন্দ্র রাজোয়ার।

পরে আলোচনা সভায় জাতীয় আদিবাসী পরিষদ জেলা কমিটির সভাপতি আমিন কুজুর এর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন মহাদেবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুজ্জামান। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিমল চন্দ্র রাজোয়ার, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আইএসসির সভাপতি ডি এম আব্দুল বারী ও নির্বাহী পরিচালক আবুল হাসনাত, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ নওগাঁ জেলা কমিটির উপদেষ্টা আজাদুল ইসলাম, পত্নীতলা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক একাডেমির পরিচালক যোগেন্দ্রনাথ সরকার প্রমুখ।

বর্তমান বাংলাদেশ

Link copied!