নওগাঁর আত্রাই উপজেলার সাহাগোলার ৫৮ বছরের আব্দুল খালেক। তিনি ১০ বছর থেকে বাড়তি আয়ের আশায় খেজুর রস সংগ্রহ করছেন। তিনি শুধু লালি বানান। প্রতিদিন ১০ কেজি করে লালি পাবে। যা তার একটা বাড়তি আয় হবে।
আরেক গাছী সোহেল রানা। তিনি এসেছেন নাটোরের লালপুর থেকে। তিনিও বাড়তি আয়ের আশায় ২২ বছর থেকে এই গাছ লাগানোর কাজ করছেন। তাই এবারও এসেছেন খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতে।
বর্তমানে এভাবেই নওগাঁয় ব্যস্ত সময় পার করছেন গাছিরা। আর এতেই রাস্তার পাশে অযত্নে অবহেলায় থাকা খেজুর গাছের কদর বাড়তে শুরু করেছে।
এখনও শীতের তীব্রতা শুরু হয়নি। বর্তমানে রাতের শেষভাগে হালকা শীত, সকালে ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু আর ভোরের কুয়াশা জানান দিচ্ছে শীতের আগমন। ফলে গ্রামীণ জনপদে শীতের এই আমেজে জানান দিচ্ছে খেজুরের রস ও গুড়ের স্বাদের কথা।
শীত এখনো না নামলেও খেজুরের রস সংগ্রহ শুরু করেছে নওগাঁর গাছিরা। সেই রস দিয়ে লালি ও গুড় তৈরির প্রস্তুতি শুরু করেছেন গাছিরা। আর কদিন পরই পুরোদমে শুরু হবে রস সংগ্রহ, তাই গাছিদেরও বেড়েছে ব্যস্ততা। আগামী ৪-৫ মাস চলবে রস সংগ্রহের কর্মযজ্ঞ, যা থেকে থেকে তৈরি হয় সুমিষ্ট পাটালি, লালী ও গুড়। পরিবারে যোগান দিবে বাড়তি আয়ের।
নওগাঁর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়- জমির আইল, রাস্তার পাশ এবং পুকুর পাড়ে বছরজুড়ে অযত্ন-অবহেলায় খেজুর গাছগুলো পড়ে থাকলেও এখন কদর বেড়েছে। কারণ এসব গাছ দিবে শীত মৌসুমজুড়ে আহরিত সুমিষ্ট রস। তাই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক গাছ থেকে অন্য গাছে ডাল কেটে পরিষ্কার করতে ছুটছেন গাছিরা। হাতে দা, কোমরে রশি বেঁধে নিপুণ হাতে গাছ তৈরি করছেন তারা। এরই মধ্যে অনেকে রস সংগ্রহের জন্য গাছে নলি গাঁথা শুরু করেছেন।
গাছিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে খেজুরের গাছ তোলা (গাছের উপরিভাগ চেঁছে পরিষ্কার করা) হয়। কয়েক দিন রেখে দিয়ে গাছের তোলা অংশ শুকানো হয়। এরপর খেজুরগাছ চেঁছে ওপরের দিকে দুটি চোখ কাটা হয়। নিচের দিকে বসানো হয় নলি। পরে সেখান থেকে রস সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। শীত মৌসুমে ৪-৫ মাস খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা যায়। যত বেশি শীত পড়ে, গাছ থেকে তত বেশি রস সংগ্রহ করা হয়। তবে গ্রামের মাঠে আর মেঠোপথের ধারে কিছু গাছ থাকলে বিভিন্ন কারণে দিনে দিনে কমছে খেজুরের গাছের সংখ্যা বলে জানান তারা।
আত্রাই উপজেলার সাহাগোলা এলাকার গাছি আব্দুল খালেক বলেন, এখানে ‘১৮টি গাছ থেকে এবার রস সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু করেছি। এছাড়া আরও কিছু গাছ লাগাবো। সবগুলো গাছ রেল লাইনের ধারে। তাই কাউকে কিছু দেওয়া লাগে না। আমি শুধু লালি বানায়। সবগুলো গাছের রস থেকে প্রতিদিন ১০ কেজি করে লালি পাবো।
গত বছর প্রতিকেজি লালি বিক্রি করেছি ১৮০-২০০ টাকায়। এতে আমার সংসারে একটা বাড়তি আয় আসে।
পার্শ্ববর্তী নাটোরের লালপুর থেকে এসেছেন আরেক গাছি সোহেল রানা। তিনি সাহাগোলা এলাকায় গাছ লাগানোর কাজ করছে। কথা হলে তিনি বলেন, ২৫ বছর ধরে খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করছি।‘এ বছরও ৭০টির বেশি খেজুরের গাছ তোলার (পরিচর্যার) কাজ শুরু করেছি। আমি গুড় তৈরি করি। শীত মৌসুমে ভালো আয় হয়।
তিনি বলেন, গাছগুলো চুক্তি করে নেওয়া হয়েছে। প্রতি গাছ থেকে মালিককে দিতে হবে ৫ কেজি করে গুড়। এক খেজুরগাছ থেকে প্রতিদিন চার কেজির মতো রস পাওয়া যায়। আর ৬ কেজি রস থেকে ১ কেজি গুড় পাওয়া যায়।
প্রতিকেজি গুড় ২০০-২২০ টাকা কেজি বিক্রি হয়।’ তাই এই খেজুরের গাছ কেটেই বছরের ৬ মাস সংসার চালাই। এখন নতুন গাছি আর পাওয়া যায় না। কেউ এসব কাজে আসতে চান না। খেজুর গাছও কমছে, গাছিও হারিয়ে যাচ্ছে।’
সদর উপজেলার দিঘিরপাড় গ্রামের গাছি আকামত আলী বলেন, ‘আমি আগে প্রায় ১০০ গাছ কাটতাম। এখন সেটি এসে দাঁড়িয়েছে ৩০-৪০টি। শীতের শুরুতে রস কম পাওয়া যায়। যত বেশি শীত পড়ে, গাছ থেকে তত বেশি রস পাওয়া যায়। কাঁচা রস বিক্রির পাশাপাশি পাটালি ও লালী গুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি করি। তবে বর্তমানে যে হারে খেজুর গাছ হারিয়ে যেতে বসেছে, হয়তো এক সময় আমাদের এলাকায় খেজুর গাছ খুঁজে পাওয়া যাবে না।

আপনার মতামত লিখুন :