ঢাকা রবিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৫

সাংগঠনিক কার্যক্রমে দুর্বল নওগার এনসিপিতে নেই সমন্বয়; হতাশায় পদত্যাগের কথা ভাবছেন অনেকেই

বিকাশ চন্দ্র প্রামানিক ( নওগাঁ)

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৬, ২০২৫, ১০:২৫ এএম

সাংগঠনিক কার্যক্রমে দুর্বল নওগার এনসিপিতে নেই সমন্বয়; হতাশায় পদত্যাগের কথা ভাবছেন অনেকেই

ছবি বর্তমান বাংলাদেশ

চলতি বছরের গত ১৯ জনু বাংলাদেশ নাগরিক পার্টির (এনসিপি‍‍`র) নওগাঁ জেলা শাখার সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। মনিরা শারমিনকে প্রধান সমন্বয়কারী করে ৩৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির অনুমোদন দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম ও সদস্য সচিব আখতার হোসেন।

এছাড়া কমিটিতে ৩ জনকে যুগ্ম সমন্বয়কারী ও ৩১ জনকে সদস্য করা হয়েছে। উদ্দেশ্য সাংগঠনিক কার্যক্রম বৃদ্ধি করা। সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করে তাদের পাশে থাকা। প্রতিটি উপজেলায় কমিটি করা। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনো উপজেলার কমিটি গঠন করতে পারেনি জেলার নেতারা।

যার কারণে মাত্র ৪ মাসেই নওগাঁয় এনসিপি নেতাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে দলের নেতৃত্বদানকারীর কর্মকান্ড এবং বিতর্কিতদের প্রাধান্য দেওয়াকে নিয়ে।

তাই এনসিপির ডাকে তেমন আর লোকজন হয়না। সর্বশেষ সদস্য সচিব আখতার হোসেনসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দের ওপর হামলার প্রতিবাদে গত ২৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় শহরের নওজোয়ান মাঠের সামনে ডাকা বিক্ষোভ সমাবেশে হাতে গোনা কয়েকজনকে নিয়ে সমাবেশ করতে হয়েছে তাদেরকে। সেখানেও আছে বিতর্ক। যোগ দিয়েছিল জাতীয় পার্টির এক নেতা। জানানো হয়নি নিজ দলের নেতাকর্মীদেরকেই।

এদিকে কমিটির নেতৃত্বদানকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে লিখিত ভাবে জানিয়েও প্রতিকার মিলছে না। তাই হতাশায় ভুগছেন কমিটির অধিকাংশ নেতাকর্মী। যেকোনো সময় পদত্যাগের ঘোষণা দিতে পারেন এমনটাই ইঙ্গিত দিলেন অনেকেই। এর প্রধান কারণ সমন্বয়হীনতার অভাব।

জানতে চাইলে জেলা কমিটির অন্যতম সদস্য আসাদুজ্জামান মুঠোফোনে বলেন, নওগাঁতে মনিরা শারমিনের নেতৃত্বে বৈষম্য বিরোধীসহ বিভিন্ন জনকে নিয়ে কার্য়ক্রম যখন শুরু হলো, তখন ভেবেছিলাম একটা ভালো কিছু হবে। যখন সমন্বয় কমিটি ঘোষণা হয়, তখন বিতর্কিত বিষয় জড়িয়ে যায়। যেখানে সঠিক ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেওয়া কাউকে আমরা পাইনি।

তিনি ক্ষোভের সহিত আরও বলেন, যেকোনো প্রোগ্রাম করার আগেই নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়। একপক্ষের কথা শুনেই আরেক পক্ষকে দোষারোপ করা, ট্যাগ দেওয়া। আর এই ট্যাগিংয়ের কারণে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দাবায়তে চেষ্টা করছে।

আসাদুজ্জামান বলেন, এই কমিটিতে সঠিক তত্ত্বাবধান হয়নি। এছাড়া কেউ ফ্যাসিস্ট থেকে আসার পরও ভুল স্বীকার করছে না। আর এদের কারণে বৈষম্য বিরোধীদের প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। তখন তারা মান সন্মানের ভয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, সরে গিয়েছে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে আলোচনা হয়না। হঠাৎ করে কোথায় থেকে যেন একটা সিদ্ধান্ত চলে আসে। যেটা গুটি কয়েক জন জানে।

তিনি বলেন, এনসিপি জুলাই আন্দোলনের স্পিডকে ধরে নতুন একটা দল। এই নতুন দলকে পাবলিক সেন্টিমেন্ট বিবেচনা করে চলতে হবে, নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নমনীয় ও বিচক্ষণ হওয়া উচিত। সবচেয়ে বড় কারণ সমন্বয়হীনতা। এছাড়া কমিটির প্রধান মনিরা শারমিন এখানে কম থাকেন। উনি যাদেরকে মেনশন করে দায়িত্ব দেন, তারাও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। যার কারণে এই অবস্থা।

সর্বশেষ এনসিপি যে বিক্ষোভের আয়োজন করেছিল, সেখানেও রানা জোয়ারদ্দার নামে জাতীয় পার্টির একজনকে এন্ট্রি করানো হয়েছিল সোহাগ ভাইয়ের মাধ্যমে।

তার মতো একই সুরে আরেক অন্যতম সদস্য ইমরুল আখিয়ার পরাগ বলেন, এনসিপিতে অনেক আশা নিয়ে যোগদান করেছি। এই দলের প্রতি জনগণের একটা চাওয়া আছে। যেকোনো দলের নেতৃত্ব অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এছাড়া বয়সেরও একটা বিষয় থাকে। তাই সঠিক নেতৃত্ব দিতে না পারলে আগামী দিনে হয়তোবা এনসিপি থেকে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে।

ওই দুই নেতার সাথে একমত পোষণ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যুগ্ম সমন্বয়কারী বলেন, আমাদের নেতৃত্বদানকারীর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। তাদের বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দেওয়া আছে। কিন্তু কোনো সমাধান মেলেনি। আমরা চেয়েছিলাম ভালো কিছু করার। কিন্তু সমন্বয়হীনতার অভাবে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আর কিছু দিন দেখবো। এরপর সুরাহা না হলে হয়তোবা অনেকেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হবে।

তবে ওই তিনজনেরই একই অভিযোগ, ফ্যাসিস্টের সাথে সম্পৃক্ত কোনো দল থেকে যদি কেউ এসেও থাকে, তাহলে তারা ভুল স্বীকার করছে না। আমাদের কথা তারা অন্তত ভুল স্বীকার করুক।

জানতে চাইলে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র নেতা ফজলে রাব্বি বলেন, বিগত জুলাই আন্দোলনে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের ভূমিকা ছিল মুখ্য ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমরা কেন্দ্রীয় নেতাদের সন্মান করি এবং এনসিপি দলের প্রতি সমর্থন আছে। কিন্তু এনসিপির নওগাঁর গঠিত কমিটিতে বিতর্কিত ব্যক্তির কারণে অনেকে চাইলেও এখানে আসতে চাচ্ছে না। এছাড়া সমন্বয়হীনতার কারণে আজ এনসিপি তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম এই জেলাতে সঠিক ভাবে পালন করতে পারছে না। আর এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে হয়তো অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। কাজেই সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমে এনসিপিকে জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণে এগিয়ে যেতে হবে।

একইভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া অপর দুই ছাত্র নেতা আরমান হোসেন ও সাদনান সাকিব। তারা বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের সম্মুখ সারিতে যারা ছিলেন, সেই সকল ভাইদের দল এই এনসিপি। সেটাতে আমাদের ভালো লাগা অবশ্যই থাকে, আমরা সমর্থন করি। তাদের কাছে জনগণের অনেক চাওয়া। আমরা মনে করি জনগণের প্রত্যাশা পূরণে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

কিন্তু এখানে একসাথে থাকলেও নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল শুরু হয়েছে। তারা নতুন বন্দোবস্তোর নামে পূরোনো বন্দোবস্তোর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে, প্রতিস্থাপন করছে। নতুনত্ব কিছু পাচ্ছি না। যা মোটেই কাম্য নয়। এটা আমাদের আশাহত করেছে।

তারা বলেন, এনসিপি যেহেতু তরুণ রাজনৈতিক দল, কাজেই এটা নিয়ে আরও বেশি কাজ করা উচিত। যেন তরণরা নতুন কিছু পায়। কিন্তু সমন্বয়হীনতার অভাবে যদি 
অভ্যন্তরী কোন্দল লেগেই থাকে, তাহলে অভ্যুত্থানের শক্তি নিয়ে গঠিত একটা দল খুব নিমিষেই খারাপ পরিণতির দিকে যেতে পারে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ১নং সদস্য দেওয়ান মাহবুব আল হাসান সোহাগ মুঠোফোনে বলেন, আমাকেও অনেকে আওয়ামী লীগ ট্যাগ দিয়ে একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। কিন্তু আমি আওয়ামী বিরোধী অনেক কিছু লেখালেখি করেছি। তাই গত ২১বা ২২ সালে আমার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছিল, এবং গ্রেপ্তার হয়েছিলাম। তাই পরবর্তীতে একজনের কথায় দুটো ছবি তুলেছিলাম। পরে সেই ছবি এডিট করা হয়েছে।

এছাড়া জাতীয় পার্টির রানা জোয়ারদ্দার সম্পর্কে তিনি বলেন, সে দুই বছর ধরে দলে ইনএ্যাক্টিভ, আর গোলাম রাব্বানী আওয়ামী লীগ করতো বলে ভুল স্বীকার করেছে।

তিনি বলেন, যারা এসব অভিযোগ করছে, তারা গুপ্ত সংগঠনের হয়ে কাজ করছে। তবে সাংগঠনিক কার্যক্রম একটু কম স্বীকার করে তিনি বলেন, আগামীতে এটা আর থাকবে না। খুব দ্রুত ভালো কিছু দেখতে পাবেন।

আর পদত্যাগের কথা আমার কানেও এসেছে, তবে এটাও ঠিক হয়ে যাবে। আমরা সমন্বয় করে ভালো কিছু করার চেষ্টা করছি।  

জানতে চাইলে নওগাঁ জেলার প্রধান সমন্বয়কারী মনিরা শারমিন মুঠোফোনে বলেন, এনসিপি একটা নতুন দল। তাই সাংগঠনিক ভাবে একটু দুর্বল। আর অভ্যুত্থান পরবর্তী নানান ধরনের মানুষ এখানে এসেছে। সেই জন্য আমরা সমন্বয় কমিটি করেছি। এখানে অনেকের সম্পর্কে জানা হয়েছে। অনেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। শুধুমাত্র পদ পদবীর জন্য এসেছে।

তিনি বলেন, আশা করছি অল্প দিনের মধ্যেই একটা আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হবে। আমরা কমিটি দেওয়ার জন্য অনেক বার মিটিং করেছি, সমন্বয় করতে চাচ্ছি, কিন্তু অনেকে সাড়া দিচ্ছে না।

মনিরা শারমিন বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য হবে এনসিপির সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতিশীলতা আনা। এখানে অনেকে আছেন যারা পদ পদবী ছাড়াই অনেক ত্যাগ ও পরিশ্রম করেছেন। বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাদের সেই কাজের মূল্যায়নের ভিত্তিতেই এনসিপি নতুন কমিটি গঠন করবে। তবে এখানে এমন কোনো মানুষ থাকবে না, যারা সরাসরি ফ্যাসিস্ট আমলে ছাত্র হত্যার সাথে জড়িত ছিল।

আর যারা কোনো না কোনো ভাবে আওয়ামী লীগ বা জাতীয় পার্টি করেছে বা সমর্থন ছিল, তারা আসতে চাইলে অবশ্যই অনুশোচনা ও ভুল স্বীকার করতে হবে।

আমাদের উদ্দেশ্য হবে সাধারণ জনগণের অধিকার নিয়ে কথা বলবে, তাদের সাথে মিশতে হবে। যারা পদ পদবী নিয়েই থেমে থাকবে না, পদ পদবী নিয়ে নিজের সুযোগ সুবিধার কথা না ভেবে নাগরিক সুবিধার কথা ভাববে। 
তাই আশা করছি আগামীতে সাংগঠনিকভাবে অনেক এগিয়ে যাবে এনসিপি।

বর্তমান বাংলাদেশ

Link copied!